রাসুলুল্লাহর স. যুগে ক্যালিগ্রাফি
-মোহাম্মদ আবদুর রহীম
মানুষ তার জীবন যাপনে বিশ্বাসকে অবলম্বন করে চলে। পৃথিবীর সব বিশ্বাস অলৌকিক শক্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। মানুষ যেহেতু পৃথিবীতে আগন্তুক বা বাইরে থেকে আসা প্রাণী, তাই মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অদৃশ্যের জগতের প্রতি ঝোঁকপ্রবন। মানুষ চায় তার বিশ্বাসকে ঘিরে একটা ধর্মকে আকড়ে ধরতে। এজন্য মানব সম্প্রদায় নানান ধর্মমতে তার জীবনকে পরিচালিত করে। পৃথিবীতে যেসব ধর্ম ও তার বাহক মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই পেয়েছে, তন্মধ্যে ইসলাম ধর্ম অন্যতম। এটা শুধু ধর্ম নয় বরং দীন বা জীবন ব্যবস্থা। একজন মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যত কাজ করবে তা দীন ঠিক করে দেবে, সেটা কোন উপায়ে করা যাবে বা কোন উপায়ে করা যাবে না। মুসলমানদের সৌভাগ্য যে, তাদের আছে একটি অবিকৃত জীবন বিধান ”আল কুরআন” এবং এ বিধানের বাস্তব উপস্থাপন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ স. এর সুন্নাহ। পবিত্র কুরআনে রাসুলুল্লাহ স.কে মহান চরিত্রের অধিকারী, সর্বোত্তম আদর্শ এবং সারা জগতের রহমত(কল্যাণ, করুণা, মায়া-মহব্বত, উপকার, চুড়ান্ত সফলতা) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ শুধু খেয়ে পরে বাচতে চায় না, তার মানসিক শান্তি ও আনন্দের জন্য সে শিল্পকলার প্রতি আকৃষ্ট হয়। মুসলমানরা শিল্পকলাকে ইসলামের আলোকে রাসুলুল্লাহ স. এর সুন্নাহর আয়নায় দেখতে চায়। এই শিল্পকলা মূলত তৌহিদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। মোটাদাগে একে আমরা ক্যালিগ্রাফি, নকশাকলা ও স্থাপত্যে দেখতে পাই। এখানে আমরা ক্যালিগ্রাফি নিয়ে কথা বলব।
ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে সবচেয়ে যে প্রশ্নটির সম্মুখিন আমরা হই, সেটা হলো রাসুলুল্লাহ স. এর সময় কোন শৈলিতে কুরআন লেখা হয়েছে? তার কি কোন নমুনা আছে? এর জবাব আমাদের ক্যালিগ্রাফি অঙ্গনে সবার কাছে তুলে ধরার জন্য এ আলোচনা।
রাসুলুল্লাহ স. পবিত্র কুরআন লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব কয়েকজন সাহাবীকে দিয়েছিলেন। চার খলিফাসহ কুরাইশ ও আনসার সাহাবীদের প্রায় ৪৩ জন এই মহান দায়িত্ব পালন করেন। এদের মধ্যে যায়েদ বিন সাবিত রা. ছিলেন সচিব। রাসুল স.-এর নির্দেশে তিনি হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন মাত্র ১৫ দিনে। ইহুদিদের সন্তানদের কুরআন শেখানোর দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়।
আরবি লিপি ইসলাম পূর্ব সময়ে প্রধানত দুই রীতিতে লেখা হত। এক. জাঝম, দুই. মুসনাদ।
খাত্তুল জাঝম হচ্ছে উত্তর আরবের থেকে আসা লিপি। আর মুসনাদ হচ্ছে দক্ষিণ আরব অর্থাত ইয়েমেন অঞ্চল থেকে আসা লিপি। আরবরা শীত ও গ্রীষ্মে ইয়েমেন ও সিরিয়ায় বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে যেত। ফলে হিসাব কিতাবের জন্য তাদের এই দুই লিপিতে লিখতে হত। তবে ইরাকের ফোরাত তীরবর্তী হিরা ও আম্বর নগরের লিপিই উত্তর আরবীয় লিপি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে।
ইতিহাসবিদ ইবনে নাদিমের বর্ণনানুসারে, মক্কা নগরীতে আরবি লিপি প্রচলন করেন আবু সুফিয়ানের ভগ্নিপতি বিশর ইবনে মালিক। এছাড়া
ঐতিহাসিক বালাজুরীর মতে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, সর্বপ্রথম তাঈ গোত্রের শাখা বাওলানের তিনজন লোক আরবি বর্ণসমূহ উদ্ভাবন করেন। তারা হলেন- মুরামির ইবনে মুররাহ, আসলাম বিন সুদরাহ এবং আমির বিন জুদরাহ।
তারা আম্বর নগরীতে এসে সিরিয়ার বর্ণমালার মডেল অনুসরন করে আরবী হরফ উদ্ভাবন করেন। মুরামির হরফগুলোর আকৃতি তৈরি করেন, আসলাম হরফগুলোর একক ও যৌগিক রূপ বানান এবং আমির নুকতার প্রয়োগ সমপন্ন করেন। এভাবে আরবি লিপি নাবাতি হিরি- আম্বরি লিপি থেকে স্বাতন্ত্র্য লিপি হিসেবে প্রচলিত হয়। এলিপিটি কিছুটা সংস্কার হয়ে হেজাজে এসে হেজাজী লিপি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
হেজাজী শৈলি হচ্ছে কুরআনের প্রথম লিপি। এই লিপি বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে দু'ধরণের। এক. মায়েল (হেলানো) দুই. মাশক(আটোসাটো)। এরপরই কুফার ক্যালিগ্রাফারদের প্রচেষ্টায় কুফি লিপি কুরআনের লিপি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হযরত ওসমান, আলী এবং হাসান, হুসাইন রা. কুফি শৈলির ওস্তাদ ছিলেন। বাকি সাহাবিগন হেজাজী শৈলির ওস্তাদ ছিলেন।
রাসুলুল্লাহ স. ক্যালিগ্রাফির গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, উত্তম ক্যালিগ্রাফি সত্যের উজ্জ্বলতাকে উদ্ভাসিত করে। তিনি আরো বলেন, প্রত্যেক ভূমিষ্ঠ সন্তানের তিনটি অধিকার রয়েছে, এক- তার জন্য একটি উত্তম নাম দেয়া, দুই- তাকে ক্যালিগ্রাফি শেখানো এবং বালেগ(প্রাপ্ত বয়স্ক) হলে তাকে বিবাহ দেয়া।
ক্যালিগ্রাফির জনক বলা হয় চতুর্থ খলিফা ও রাসুলুল্লাহ স. এর জামাতা আলী বিন আবু তালিব রা.কে। তিনি ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, তোমরা ক্যালিগ্রাফির শিক্ষা গ্রহণ কর, কেননা এটা তোমাদের রিযিকের সহায় হবে। তিনি নিজে ক্যালিগ্রাফির মহান উস্তাদ ছিলেন। ক্যালিগ্রাফি শেখার নীতিমালা সম্পর্কে তিনি বলেন, ”ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে রহস্যময় বিদ্যা, এটা উস্তাদের শিক্ষার মাধ্যমে উন্মোচিত হয় এবং অধিক চর্চার মাধ্যমে আয়ত্বে আসে ও নিয়মিত অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে টেকসই হয়।” ক্যালিগ্রাফির মূল হাতিয়ার ক্যালিগ্রাফি কলম সম্পর্কে তিনি বলেন, ”তোমাদের ক্যালিগ্রাফি কলমের নিবটির অগ্রভাগ এতটুকু প্রলম্বিত করো, যাতে ক্যালিগ্রাফি সুন্দর হয়।”
রাসুলুল্লাহ স. পবিত্র কুরআনকে লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে আরবি ক্যালিগ্রাফি শিল্পের উন্নয়ন শুরু হয়। সেই সময়ে লাইয়েন হিজাজী শৈলীতে সাহাবীগণ পবিত্র কুরআন লিপিবদ্ধ করতেন। যেহেতু বিভিন্ন সময়ে আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপটে এই লিপিবদ্ধ করা চালু ছিল। দীর্ঘ ২৩ তেইশ বছর ব্যাপী এটা কাগজ, কাপড়, হাড়, গাছের বাকলে লেখা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. এর ওফাতের পর আবু বকর রা. এর সময়ে ইমামার যুদ্ধে বহু সংখ্যক(প্রায় ৭০ জন) কুরআনে হাফেজ সাহাবী শহীদ হন। এতে ওমর বিন খাত্তাব রা. উদ্বিগ্ন হয়ে খলিফা আবু বকরকে বিষয়টি অবহিত করে পবিত্র কুরআনকে একটি মুসহাফে সংকলনের অনুরোধ জানান। খলিফা কাল বিলম্ব না করে যায়েদ বিন সাবিত রা.কে প্রধান করে একটি কমিটি করে দেন। ঐ কমিটিতে ১২জন সদস্য ছিলেন। ওসমান ইবনে আফফান রা., আলী ইবনে আবু তালিব রা., তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ রা., আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., উবাই ইবনে কাব রা., খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রা., হুযায়ফা রা., ও সালেম রা., এর মত বিখ্যাত সাহাবিগণ কমিটিতে ছিলেন।
এই কমিটি প্রথম বৈঠক করেন ওমর বিন খাত্তাব রা. এর আঙিনায়। সেখানে ঘোষণা করা হয়, যার কাছে পবিত্র কুরআনের যতটুকু লেখা আছে তা উপস্থাপণের জন্য এবং প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি আয়াত দুজন হাফেজে কুরআন দ্বারা যাচাই করে জমা নেয়া হয় এবং এগুলোর প্রতিটির সপক্ষে দুজন করে সাক্ষী নেয়া হয়, যারা তা স্পষ্ট পড়তে পারেন।
পবিত্র কুরআনের আয়াত, সুরার বিন্যাস রাসুলুল্লাহ সা. ফিরিশতা জিবরাইল আ. এর মাধ্যমে করেছিলেন। এতে ৬,২৩৬ আয়াত, ১১৪টি সুরা এবং প্রায় ৩,২৩,০০০ হরফ রয়েছে।
যখন ঐ কমিটি কুরআনের সমস্ত অংশগুলো হাতে পেলেন, তা যাচাই বাছাইয়ের পর একটি মুসহাফে লিপিবদ্ধ করার জন্য একজন বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার খোজ করলেন। তখন মদিনায় সাঈদ ইবনুল আস রা. ছিলেন সবচেয়ে ভাল ক্যালিগ্রাফার। তাকে নিয়োগ দেয়া হয় পবিত্র কুরআন সংকলনের জন্য। কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে তিনি হরিণের(গাজাল, আরব উপদ্বীপের ছোট আকৃতির হরিণ) চামড়া দিয়ে বানানো মুসহাফে তা হেজাজী শৈলীতে লিপিবদ্ধ করেন। হেজাজী শৈলী সম্পর্কে সাহাবীগণ ভাল জানতেন, কারণ এ শৈলীটি নবী ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম আ. হেজাজে প্রচলন করেছিলেন।
পবিত্র কুরআনের এ মুসহাফটি প্রথমে সাহাবীদের একটি সাধারণ সভায় উপস্থাপণ ও তেলাওয়াত করা হয়। এতে সবাই একমত পোষণ করেন এবং একে ”মুসহাফ”(লিখিত কিতাব) নামকরণ করা হয়, তারপর সেটা সর্বসাধারণের দেখা ও যাচাইয়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। প্রায় ৩৩ হাজার সাহাবী মুসহাফটির প্রতিটি হরফ, আয়াত ও সুরা যাচাই করে একমত পোষণ করেন। তারপর সেটা ওমর বিন খাত্তাব রা. এর জিম্মায় সংরক্ষণের জন্য দেয়া হয়। ওমর রা. এর ওফাতের পর মুসহাফটি উম্মুল মুমিনিন ও ওমর রা. এর কন্যা হাফসা রা. কাছে সংরক্ষণের জন্য দেয়া হয়। উল্লেখ্য, হাফসা রা. ছিলেন মহিলা সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত, তিনি রাসুলুল্লাহ সা. এর নির্দেশে মদিনার মহিলা ও বাচ্চাদের কুরআন শেখাতেন।
তৃতীয় খলিফা ওসমান রা. আমলে আরমেনিয়ার যুদ্ধ চলাকালে সিরিয়া ও ইরাকের মুসলমানদের কুরআন তেলাওয়াতে গরমিল দেখা দেয়। যুদ্ধ থেকে ফিরে বিষয়টি হুযায়ফা রা. খলিফার কাছে অভিযোগ করেন এবং তা সমাধানের অনুরোধ জানান।
২৫ হিজরীতে(৬৪৭ খ্রি.) খলিফা ওসমান ইবনে আফফান রা. এর নির্দেশে সমস্ত অঞ্চল থেকে কুরআনের কপি মদিনায় প্রেরণের ঘোষণা দেয়া হয়, সেগুলো মদিনায় এসে পৌছালে একটি প্রতিনিধিদলের সভা আহবান করা হয়। সেই সভায় আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর রা., সাঈদ ইবনুল আস রা., আবদুর রহমান ইবনে হারিছ রা. প্রমুখসহ যায়েদ ইবনে সাবিত রা. এর নেতৃত্বে সব সাহাবী একত্রিত হন। তাদের মধ্যে যায়েদ ইবনে সাবিত রা. ছাড়া সবাই ছিলেন কুরাইশ গোত্রের। সভায় খলিফা ওসমান ইবনে আফফান রা. কুরাইশদের রীতিতে কুরআন পঠন, পাঠন ও লিপিবদ্ধ করার বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তখন যায়েদ বিন সাবিত রা. ( রাসুলুল্লাহ স. আদেশে তিনি কুরআন লিপিবদ্ধকারী সাহাবীদের নেতৃত্ব ও সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন) বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. কুরাইশ বংশোদ্ভুত হলেও আরবি ভাষার সাত কেরাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। যদিও তা কুরাইশদের রীতিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং রাসুলুল্লাহ স. এর নির্দেশিত পথে তা করতে হবে। তখন সভার সিদ্ধান্তক্রমে হাফসা রা. কাছে রক্ষিত মুসহাফ, আলী রা. কাছে রক্ষিত কুরআন এবং আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর কাছে রক্ষিত কুরআনটি আনা হয় এবং তা সমন্বয় করে কুরাইশ রীতিতে কুরআনের সাতটি মুসহাফ লেখা হয়। উল্লেখ্য, হাফসা রা. এর কাছে রক্ষিত মুসহাফটিতে সুরাগুলো আলাদা ছিল না এবং কোন হাশিয়া(মার্জিন) ছিল না। সভার সিদ্ধান্তক্রমে সুরা আলাদা ও হাশিয়া রাখা হয়।
এই সাতটি কুরআনের মুসহাফ তৈরির পর জমাকৃত অন্যসব কপি পুড়িয়ে ফেলা হয়।
এই সাতটি কুরআনের কপির প্রত্যেকটির সাথে একজন কারী সহ(তেলাওয়াতকারী) বাহরাইন, দামেশ্ক, বসরা, কুফা, ইয়েমেন ও মক্কায় প্রেরণ করা হয়। এসব অঞ্চলে মুসহাফটি তেলাওয়াত ও কপি করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কারী সাহাবীর মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। কোন কোন রেওয়ায়েত(বর্ণনায়) আছে, মিশর ও জাজিরায়ও মুসহাফ পাঠানো হয়েছিল।
চতুর্থ খলিফা ও কুফি ক্যালিগ্রাফির বিখ্যাত উস্তাদ আলী ইবনে আবু তালিব রা. এর সময়ে আরেক বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার আবুল আসওয়াদ দুআইলির মাধ্যমে কুরআনের হরফে নোকতা প্রনয়ণ এবং উমাইয়া শাসক আবদুল মালিকের সময়ে হেজাজের শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিখ্যাত আরবি শাস্ত্রবিদ ও ক্যালিগ্রাফার খলিল ইবনে আহমদের মাধ্যমে জের, জবর, পেশ, মদ, শাদ্দাহ প্রভৃতি উচ্চারণ চিহ্নগুলো সিরিয়াক বর্ণমালা থেকে সংগ্রহ ও সংস্কার করে কুরআনে প্রয়োগ করেন, এতে অনারবদের কাছে কুরআন পাঠ ও তেলাওয়াত সহজ হয়ে যায়।
রাসুলুল্লাহ স. এর সময়ে আরবি ক্যালিগ্রাফির মান সম্পন্ন উন্নয়ন সাধিত হয়। তিনি রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহারের জন্য একটি সিলমোহর আংটি আকারে তৈরির নির্দেশ দেন, যাতে ”মুহাম্মদ রাসুল আল্লাহ” খোদাই থাকবে। সেটা তৈরির পর দেখা গেল খাড়াভাবে প্রথমে মুহাম্মদ, মাঝে রাসুল এবং নিচে আল্লাহ শব্দ খোদাই করা হয়েছে। এটা আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী ঠিক ছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ স. আংটিতে ’আল্লাহ’ শব্দটি উপরে খোদাই করার নির্দেশ দেন। ফলে আরবি ক্যালিগ্রাফিতে কম্পোজিশন বা বিন্যাসের ক্ষেত্রে লফজে জালালাহ (আল্লাহ শব্দ) সবার উপরে রাখার নীতিমালা চালু হয়ে যায়।
রাসুলুল্লাহ স. সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকদের কাছে পত্র পাঠানো হয়েছিল। এসব পত্রের লেখা হেজাজী লাইয়েন শৈলীতে লেখা ও রাসুলুল্লাহ স. এর সিল মোহর দিয়ে ছাপাঙ্কিত ছিল।
রাসুলুল্লাহ স. সময়ে সাধারণ চিঠিপত্র হিসাব কিতাব প্রভৃতি দৈনন্দিন লেখালেখিতে হেজাজী লাইয়েন(নমনীয় ও কোমল) শৈলী ব্যবহার হত। অন্যদিকে স্মারকপত্র, বিশেষ দলিলপত্র ও কুরআন লেখার ক্ষেত্রে হেজাজী মায়েল(হেলানো) ও হেজাজী মাশক(আটোসাটো) শৈলী ব্যবহার করা হত। হেজাজী লাইয়েন শৈলী লেখার কাজে ”কলম মুদাব্বাব” সুক্ষ্ম ও গোলায়িত মাথার কলম(বর্তমানের বলপয়েন্ট কলমের মত) এবং হেজাজী মায়েল ও হেজাজী মাশক শৈলী লেখার কাজে “কলম খত” (মাথা কাটা বিশেষ কলম, যাতে মোটা চিকন লেখা হয়) ব্যবহার হত। ”কলম খত” একমাত্র ক্যালিগ্রাফারগণ ব্যবহার করতেন, সাধারণ মানুষ এতে অভ্যস্ত ছিল না। কারণ এটা ব্যবহারের বিশেষ কৌশল ও নীতিমালা শুধুমাত্র ক্যালিগ্রাফারগণ জানতেন। আজও আরব বিশ্বে সাধারণ মানুষ “কলম মুদাব্বাব” দিয়ে লেখালেখি করেন এবং “কলম খত” দিয়ে শুধুমাত্র ক্যালিগ্রাফারগণ ক্যালিগ্রাফি করে থাকেন।
রাসুলুল্লাহ স. এর সময় থেকে লেখার কাজে সাধারণ কাগজ ও ক্যালিগ্রাফি করার আলাদা কাগজ, চামড়া দিয়ে বানানো মুসহাস বা রক্কে গাজাল(হরিণের চামড়ার পাতা) ব্যবহার হত। কালি হিসেবে রক্ত দিয়ে বানানো ”আহবারে আহমারি” ও চাল, নলখাগড়া, বিচালী পোড়ানো কালি দিয়ে বানানো ”আহবারে আরাবি” ব্যবহার হত। ক্যালিগ্রাফি করার ক্ষেত্রে কালির সাথে আরবি গাম, চিনি ও ফিটকিরি মেশানো হত চকচকে ও টেকসই করার জন্য। কাগজে বা পার্চমেন্টে(চামড়ার কাগজ) নাশা( স্টারচ আঠা), ডিমের সাদা অংশ ও জয়তুন তেল দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় কাগজকে তৈরি করে নেয়া হত একে স্থায়িত্ব ও লেখার মেরামত এবং সুন্দর কাজের জন্য।
ফলে রাসুলুল্লাহ স. এর সময় থেকে ক্যালিগ্রাফি একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পে রূপলাভ করে।
৯৬ হিজরিতে জেরুসালেমে কুব্বাতুস সাখরা(ডোম অব রক) ভবনের ভেতরে কুফি শৈলীর যে উপস্থাপন লক্ষ্য করা যায়, তাতে অনুমিত হয় পাথর খোদাই ও স্থাপত্যে রাসুলুল্লাহ স. এর সময় থেকেই এর প্রচলন ছিল।
সাম্প্রতিক কালে জার্মানির বার্লিন স্টেট
লাইব্রেরিতে মহানবী
হযরত
মুহাম্মদ সা.
এর
সময়কার
লেখা
পবিত্র
কোরআনের কপির
সন্ধান
পাওয়া
গেছে।
প্রায়
শত
বছর
ধরে
এটি
এই
লাইব্রেরিতে সবার
অগোচরে
পড়ে
ছিল।
জুরিখের লাইব্রেরিতে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর
৯৫
শতাংশ
নিশ্চিত হওয়া
গেছে
যে
তিন
পৃষ্ঠার চর্ম
কাগজে
কুফি
লিপিতে
লেখা
নমুনাটি ৬৪৯
থেকে
৬৭৫
সালের
মধ্যে
হাতে
লেখা
হয়েছিল। তুবিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের “কুরানিকা প্রকল্পের” গবেষকগণ এটি
নিয়ে
বিস্তারিত অনুসন্ধান চালান।
স্থানীয় একটি
সংবাদপত্রের খবরে
বলা
হয়,
দীর্ঘমেয়াদী একটি
প্রকল্পের আওতায়
এটি
পরীক্ষা নিরীক্ষা করা
হয়।
এজন্য
ইউরোপের সমগ্র
কোরআনের কপি
যাচাই
করে
দেখা
হয়।
বার্লিন লাইব্রেরিতে ১০০
বছর
ধরে
এই
কপি
সবার
অলক্ষ্যে পড়ে
ছিল।
ধারণা
করা
হচ্ছে,
মিশরীয়
এক
বিজ্ঞানী ঊনবিংশ
শতাব্দীর শেষের
দিকে
অথবা
বিংশ
শতাব্দীর শুরুর
দিকে
এটি
জার্মানিতে নিয়ে
আসেন।
গবেষকরা ধারণা
করছেন,
গ্রন্থটি মহানবী
(স.)
ওফাতের
২০-৪০ বছর পরে
লেখা
হয়েছে।
মূল
গ্রন্থের অংশবিশেষ এ
গ্রন্থটি ১৫৪
পৃষ্ঠা
সম্বলিত। সুরা
বনি
ইসরাইল(১৭)এর ৩৫
নং
আয়াত
থেকে
সুরা
ইয়াসিন(৩৬)এর ৫৬নং
আয়াত
পর্যন্ত আছে।
এর
লিপি
পর্যালোচনা করলে
দেখা
যায়,
‘হেজাজি
মায়েল
কুফী’
লিপিতে
এটি
লেখা
হয়েছে।
মূল
লেখায়
নোকতা-জের-জবর-পেশ
ছিল
না।
পরে
এতে
সংযোজন
করার
আভাষ
পাওয়া
যায়।
বিরামচিহ্ন হিসাবে
গোলায়িত তিনটি
নোকতা
ত্রিকোণাকার আকারে
দেয়া
হয়েছে।
গ্রন্থটির প্রতিটি পৃষ্ঠা
আলাদা
করে
লিখে
জুঝ
বাধাই
করে
গ্রন্থবদ্ধ করা
হয়েছে।
এতে
কোন
পৃষ্ঠা
নম্বর
নেই।
বর্তমানে কলমকে
৪৫ডিগ্রি কোনে
কেটে
লেখা
হয়
কিন্তু
এই
লিপির
কলম
১৮০
ডিগ্রি
কোনে
কাটা
হয়েছে
এবং
চাল
পুড়িয়ে
চিনি,
নিশাত
ও
আরবি
গাম(আঠা) মিশিয়ে হাতে
তৈরি
কালিতে
এটি
লেখা
হয়েছে।তবে শব্দের
মধ্যে
কোথাও
কোথাও
যের-জবর বুঝানোর জন্য
লাল
কালির
ফোটা
হরফের
উপর-নিচ খুব কাছে
ব্যবহার করা
হয়েছে।কোথাও একই
কালিতে
হরফের
নোকতা
খুবই
ছোট
ও
প্রায়
অষ্পষ্টাকারে দেয়া
হয়েছে।
উল্লেখ্য, কুরআনের লিপি
হিসেবে
প্রথমদিকে মক্কী,
মাদানী
ব্যবহৃত হত,
তেমনি
এর
লেখন
বৈশিষ্ট্য হিসেবে
জযম,
মাশ্ক,
মায়েল(আইটালিক) নামকরণ করা হত।
পরে চতুর্থ খলিফা আলী ইবনে আবু তালিব
রা. এর সময় থেকে কুফি রীতিতে কুরআন লিপিবদ্ধ করা শরু হয়। এই কুফি লিপিতে প্রায়
৩শ
বছর
কুরআন
অনুলিপি করা
হয়।
পরবর্তী ৩শ
বছর
মুহাক্কাক লিপিতে
কুরআনের অনুলিপি করা
হয়।
এরপর
রায়হানী লিপি
তেমন
ব্যবহার হয়নি,
রায়হানি লিপির
কয়েকটি
কুরআনের কপির
কথা
জানা
যায়। তারপর তুরস্কের ক্যালিগ্রাফারগণ নাসখি
লিপি
কুরআন
অনুলিপিতে ব্যবহার শুরু
করেন
এবং
এটি
এখন
পর্যন্ত কুরআনের লিপি
হিসেবে
টিকে
আছে।
ইরানে
ইসলামের বিজয়ের
পর
ইরানের
ক্যালিগ্রাফারগণ প্রথমদিকে কুফি
লিপিতে
কুরআন
অনুলিপি করেন।
ক্রমশ
এটি
এত
উন্নতি
লাভ
করে
যে,
কারামাতিয়ান কুফির
নাম
জগদ্বিখ্যাত হয়ে
যায়।
তারপর
নাশখ
এবং
তালিক
লিপির
সমন্বয়
করে
‘নাশতালিক’ লিপি
নামে
একটি
লিপি
আবিস্কার হয়।
ইরানের
ক্যালিগ্রাফারগণ নাশতালিক লিপিকে
বিশেষ
গুরুত্ব দিয়ে
কুরআন
অনুলিপিতে এর
ব্যবহার অব্যাহত রাখেন।
তবে
ইরানের
বাইরে
এই
লিপির
কুরআন
তেমন
একটা
নজরে
পড়ে
না।
পশ্চিম
আফ্রিকায় কুফি
লিপি
স্থানীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে
মাগরেবি লিপি,
আন্দালুসিয়ান কুফি,
কাইরোয়ান কুফি
ইত্যাদি স্থাননামে এবং
মাবসুত,
মাগরেবি সুলুস,
মাগরেবি নাসখী
নামে
বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লিপিতে
কুরআন
লিপিবদ্ধ করা
হয়।
চীন-জাপানে চিনি লিপি
নামে
নাশখী
লিপির
পরিবর্তিতরূপে কুরআন
অনুলিপি করা
হয়।
ভারত
উপমহাদেশে তুর্ক-আফগানদের পৃষ্ঠপোষকতায় কুফি, নাসখি লিপির
কুরআন
প্রথম
পর্যায়ে করা
হত। সমুদ্রপথে আগত
মিশর-সানআ, হেজাজের ক্যালিগ্রাফারগণ বাংলাদেশে বাহরি আর বাঙ্গালী লিপি(নাশখি ও কুফি
লিপির
সমন্বয়)
দিয়ে
কুরআন
অনুলিপি করেন।
এটা
সুলতানি আমলের
শেষ
পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
অন্যদিকে গজনি
ও
কাশ্মিরের একদল
ক্যালিগ্রাফার বাঙলার
সালতানাত শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ
করেন
এবং
নাশখি
লিপির
চমৎকার
নজরকাড়া কুরআন
অনুলিপি করেন।
লৌখনুতে রাজকীয়
পৃষ্ঠপোষকতায় লৌখনু
নাসখি
নামে
একটি
লিপিতে
কুরআন
অনুলিপি করা
শুরু
হয়।
পরবর্তিতে এটি
‘হিন্দি
নাশখী’
হিসেবে
পরিচিতি পায়।
১৮০০
সালের
পর
পশ্চিমবঙ্গ থেকে
ইংরেজদের মাধ্যমে কুফি
লিপির
পরিবর্তিত নিম্নমানের একটি
ফন্টসেট তৈরি
করা
হয়
এবং
এই
টাইপসেট দিয়ে
হাত
কম্পোজে কুরআন
ছাপা
শুরু
হয়।
এটি
আজও
অব্যাহত আছে।
এই
লিপির
কুরআনকে ‘কলিকাতা ছাপা’
কুরআন
বলে।
এতে
বাঙলার
অধিকাংশ মানুষ
অভ্যস্ত হয়ে
পড়ে।
তবে
এতে
হাতে
লেখা
কুরআনের ক্যালিগ্রাফিক বৈশিষ্ট্য ও
নান্দনিক ভাব
পাওয়া
যায়
না।
তাছাড়া
হাতেলেখা কুরআনের যে
আধ্যাত্মিক আবেদন
রয়েছে,
তা
থেকে
বাঙলার
জনগণ
বঞ্চিত
হয়েছে।
অন্যদিকে কুরআন
হিফজ
করার
জন্য
মাদ্রাসাগুলোতে লৌখনু
ক্যালিগ্রাফিক লিপির
কুরআন
ব্যবহৃত হয়ে
আসছে।
কুরআন
হিফজের
জন্য
কলিকাতা ছাপা
কুরআনের ব্যবহারের কোন
প্রমাণ
পাওয়া
যায়না।
রাসুলুল্লাহ স. এর সময়ে ক্যালিগ্রাফি নিয়ে গবেষণা চলমান রয়েছে। এপর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণে ক্যালিগ্রাফির যতটুকু পাওয়া গেছে তা আলোচনা করা হয়েছে। আশাকরা যায়, ক্যালিগ্রাফি চর্চা, গবেষণা ও এবিষয়ে আগ্রহীদের জন্য এটা দিকনির্দেশনায় সহায়তা করবে। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির শিল্পাঙ্গনকে আরো সমৃদ্ধ করতে এধরণের তথ্য অনুসন্ধান ও গবেষণা দরকার বলে মনে করি।
হেজাজী মায়েল শৈলি(হিজরী ১ম শতক)
হিন্দুস্তানী কুরআন। মদিনা মুনাওয়ারার কুরআন কমপ্রেক্স থেকে মুদ্রিত।
লেখক- ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি গবেষক।