বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে পরিপূর্ণ ক্যালিগ্রাফি সেন্টারের প্রথম একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। বিশেষকরে আরবি ক্যালিগ্রাফির নান্দনিক দিক নিয়ে অধ্যয়ন এবং ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনীর আয়োজন, ক্যালিগ্রাফি শিল্পী এবং তাদের শিল্পকর্ম নিয়ে প্রথম একটি সামগ্রিক তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা হচ্ছে। এসবের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ইসলামী শিল্পকলার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা।
এছাড়া বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যালিগ্রাফির প্রতি আগ্রহ তৈরি এবং সিলেবাসভুক্ত করা। ক্যালিগ্রাফি শিক্ষার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম আরো সৃজনশীল হতে পারে এজন্য ব্যাপকভিত্তিক কর্মশালার আয়োজন করা। এতে শিশুদের সাথে বয়স্করাও ক্যালিগ্রাফির নান্দনিকতা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
ইসলামী ক্যালিগ্রাফি আরবি লিপিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ইসলাম পূর্ব সময়ে মক্কা নগরীতে আরবি লিপি প্রথম প্রচলন করেন বিশর ইবনে আবদুল মালিক আল কিন্দি। তিনি উত্তর আরবের হিরা এবং আনবার অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছ থেকে নাবাতিয়ান লিপি লেখার শৈল্পিক জ্ঞান অর্জন করেন। প্রাচীন তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, আরবরা ইসলামের আগে থেকেই আরবি লিপিতে লেখালেখি করত। এছাড়া সেময় ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা তাদের বইপত্র হিব্র“ এবং সিরিয়াক লিপির সাথে আরবিতেও লিখত। সপ্তম শতাব্দীর প্রথম থেকেই আরবি ক্যালিগ্রাফি বিশেষকরে হেজাজে শিল্পিত হয়ে উঠতে থাকে।
আরব উপদ্বীপে ইসলাম প্রসারের সাথে সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্ব পায় আরবি লিপি। পবিত্র কুরআন আরবিতে অবতীর্ণ হওয়ায় আরব-অনারব মুসলমানদের কাছে ইসলামের ভাষা হিসেবে আরবি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সুন্নাহ নথিভুক্ত ও সংরক্ষণের জন্য আরবি লিপির ব্যবহার অনিবার্য হয়ে ওঠে। ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান ও শিক্ষা লাভের জন্য মুসলমানরা আরবিতে পড়া ও লেখার বিষয়ে আগ্রহী। সুতরাং আরবি ক্যালিগ্রাফি খুব দ্রুত উন্নয়ন ও বিকাশ লাভ করেছে। আরবি ক্যালিগ্রাফি আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে অনারব দেশগুলোতে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এটা এখন এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, আরবি ক্যালিগ্রাফির শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যে অন্যান্য দৃশ্যমান শিল্পকলার শীর্ষমানের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। গবেষকরা আরবি ক্যালিগ্রাফিকে ’লিভিং আর্ট’ বা জীবন্ত শিল্পকলা বলে অবিহিত করছেন।
আরবি ক্যালিগ্রাফির উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে লিপির ভেতর শৃঙ্খলা ও সুচারুবোধের অভাব লক্ষ্য করা যায়। তখন একে প্রশাসনিক কাজেই প্রধানত ব্যবহার করা হত। আরবি লিপি গোলায়িত অর্থাত টানা হাতের পেঁচানো লেখা এবং জ্যামিতিক স্বভাবের দুই বৈশিষ্ট্য নিয়ে উন্নতি লাভ করে। হরফ সঠিক আকার ও আকৃতিতে লেখার পদ্ধতি এবং হরফ পৃথকীকরণ চিহ্ন যাকে নোকতা বলে, তা তখনও বের হয়নি। হরফে হরফে, শব্দে শব্দে, বাক্য, যতি চিহ্ন প্রভৃতি ব্যবহারের বিষয়ে কোন সুষ্পষ্ট বিধি দেখা যায়নি। এবিষয়ে জনমনে দ্বিধা-দ্বন্ধ কাজ করত। বিশেষ করে অনারব বিশ্বে দ্রুত মুসলমাদের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আরবি লিপির ভেতর এসব অসমঞ্জস্যতা দূর করার এবং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এপ্রেক্ষিতে নোকতা (হরফ পৃথকীকরণ চিহ্ন) এবং তাশকীল (স্বরচিহ্ন) পদ্ধতি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করেন আবুল আসওয়াদ আল দোয়ালী (মৃত্যু-৬৮৮ই.)। এরপর আল খলিল ইবনে আহমদ আল ফারাহিদী (মৃত্যু-৭৮৬ই.) আবুল আসওয়াদের তাশকীল পদ্ধতিকে পুণঃসংস্কার করেন। ১১ শতকের গোড়া থেকে আন্তর্জাতিকভাবে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে এবং এতে ছয়টি স্বরচিহ্ন-কার হচ্ছে : ফাতাহ(আ-কার), দাম্মাহ(উ-কার), কাসরাহ(ই-কার), সুকুন(স্বরচিহ্ন মুক্ত চিহ্ন), সাদ্দাহ(দিত্ত্ব ব্যাঞ্জন বর্ণ চিহ্ন) এবং মাদ্দাহ(স্বরকে দীর্ঘকরণ চিহ্ন), এটা আলিফ প্রয়োগের মাধ্যমেও করা যায়।
উমাইয়া শাসন আমল হচ্ছে আরবি লিপির পরিবর্তনকালীন পর্যায়। কুফী লিপিতে ক্যালিগ্রাফি করা এ সময় পেশায় পরিণত হয়। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান একটি নতুন লিপির আবিস্কার করেন। তিনি এর নাম দেন মানসুব লিপি। উমাইয়াদের একটি স্মরণীয় কীর্তি হচ্ছে, জেরুসালেমে প্রাচীন আল কুদস নগরীতে মসজিদ আল আকসার পাশে কুব্বাতুস সাখরা(ডোম অব রক) মসজিদ নির্মাণ এবং তাতে ক্যালিগ্রাফির যুগান্তকরী প্রয়োগ।
এরপর আব্বাসীয় আমলে আরবি লিপি সৌন্দর্যমণ্ডিত ও উন্নয়ন একই সাথে হতে থাকে।
পর পর তিনজন খলিফার উজির আবু আলী ইবনে মুকলাহ(মৃত্যু-৯৪০ই.) প্রথম আরবি লিপির আনুপাতিক লেখন পদ্ধতি আবিস্কার করেন কোন জ্যামিতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার না করেই। ইবনে মুকলাহ নাশখ(কপি করা) এবং সুলুস(এক তৃতীয়াংশ) লিপির আধুনিক আকার-আকৃতি রূপায়ন করেন। তিনি গোলায়িত টানা হাতের পেচাঁনো কুফি লিপির উদ্ভাবন করেন এবং তার উত্তরসূরী ইরাকী কুরআন বিশেষেজ্ঞ ক্যালিগ্রাফার আলী বিন হিলাল ইবনে আল বাওয়াব এ লিপির উন্নয়ন করেন।
ক্যালিগ্রাফির ব্যাপক এবং শৈল্পিক প্রয়োগে চমৎকারিত্ব দেখান ফাতেমী খলিফাগণ। প্রাসাদ, মসজিদ, ও সিংহাসন সর্বত্র অঙ্গসজ্জা ও অলংকরণের কাজে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার শিল্পকর্ম হিসেবে গৃহীত হয়। ক্যালিগ্রাফিকে পেশা হিসেবে গ্রহণের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং ক্যালিগ্রাফির বিভিন্ন ধারার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সব রকম সুযোগ-সুবিধা সহজলভ্য হয়।
ওসমানীয়দের মিসর দখলের প্রেক্ষাপটে তুর্কীরা নাশখ লিপিতে অসাধারণ শৈল্পিক সুষমা আনয়ন করে। কারণ তুর্কীরা আগে থেকে গ্রীক ও উর্দু হরফের হাতে লেখার সুক্ষ্ম সৌন্দর্য সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। ১৬ শতকের মধ্যভাগে হাফিজ ওসমান ও আহমদ কারাহিশারি নাশখ লিপিকে সৌন্দর্যের চুড়ান্ত মানে উন্নীত করেন। তুর্কীদের হাত ধরে আরবি ক্যালিগ্রাফি মধ্য এশিয়া, রাশিয়া, আফগানস্তিান এবং মোগলদের হাত ধরে ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
মিসরে আরবি ক্যালিগ্রাফির উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় কাজ হচ্ছে পবিত্র কাবার গিলাফে স্বর্ণতন্তুতে কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি। খেদিভ ইসমাইলের আমন্ত্রণে বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ও নকশা শিল্পী আবদুল্লাহ বেক জুহদী মিসরে আগমন করেন। তিনি কাবার গিলাফ(কিসওয়াহ) বিশেষভাবে নকশা এবং সুলুস লিপিতে ক্যালিগ্রাফি করেন। মিসরে ক্যালিগ্রাফি রেনেসাঁর অগ্রনায়ক হিসেবে তাকে অভিহিত করা হয়। বাদশাহ ফাওয়াদের সময়ে ক্যালিগ্রাফিকে শিল্পকর্ম হিসেবে প্রদর্শনী করা হয়। বিখ্যাত তুর্কী ক্যালিগ্রাফার মুহাম্মদ আবদুল আজিজ মিসরে অবস্থান করে আরবি ক্যালিগ্রাফির একটি ধারা প্রতিষ্ঠা করেন এবং হরফকে স্বর্ণমণ্ডিত করার কৌশল প্রচলন করেন।
.
বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি এবং সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র দশটি জাতীয় ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী করেছে। ক্যালিগ্রাফির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান করছে ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি। এছাড়া ক্যালিগ্রাফি ফাউন্ডেশন, ক্যালিগ্রাফি একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ক্যালিগ্রাফির অঙ্গনে কাজ করে চলেছে। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা সুনাম অর্জন করে চলেছেন। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের শিল্পকর্ম সংগ্রহ করা হচ্ছে বিদেশের বিভিন্ন জাদুঘরে । ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে গবেষণাকর্ম প্রকাশিত ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা হচ্ছে।
তবে সামাজিকভাবে ক্যালিগ্রাফির একটি বড় ধরণের অর্জন হচ্ছে, ক্যালেন্ডার, ভিউকার্ডে এর ব্যাপক ব্যবহার। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম শোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিফট আইটেম হিসেবে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম প্রদান বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি একটি নান্দনিক শিল্পকলা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।