সুন্দরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ হচ্ছে একটি স্বভাবগত বিষয়। সভ্যতার বিকাশের ধারায় মানুষের রুচিবোধের মাত্রার পরিবর্তন হয়। খাদ্যাভাস, পোষাক, আবহাওয়া, ভৌগলিক অবস্থান প্রভৃতি মানুষকে বৈশিষ্ট্যগত প্রভাব ও জীবনধারা চয়নে পাল্টে ফেলে। সৌন্দর্যবোধকে শুধু নিজের জন্য নয়, উত্তর-পুরুষের জন্য নিদর্শন স্বরূপ রেখে যেতে যে প্রয়াস দেখা যায়, ক্যালিগ্রাফি তার ভেতর একটি অন্যতম মাধ্যম। এটি একাধারে উন্নত রুচিবোধ এবং তথ্যের সমাহারসহ সৌন্দর্য্যের আকর হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাঙালা ভূখণ্ডের প্রাচীন নিদর্শন, বিশেষ করে ক্যালিগ্রাফির যে নমুনা পাওয়া যায় তা হাজার বছরের পুরনো। গবেষকগণ প্রাচীন বাঙালা বলে যে ভূখণ্ডকে চিহ্নিত করেছেন, সেটা বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা পদ্মার দক্ষিণ পাড় থেকে সুন্দরবন অঞ্চল পর্যন্ত এলাকা। বাঙালার আরেকটি পরিচয় হচ্ছে, চট্টগ্রামকে বেংগাল বলে উল্লেখ করেছেন প্রাচীন ইউরোপীয় ভূগোল গবেষকরা। তবে ইসলাম পূর্ব সময়ে আরবরা সমূদ্র পথে ব্যবসায়-রুট হিসেবে বর্তমান বঙ্গোপসাগরকে বাহর আল হারাকান্দ বলে উল্লেখ করেছেন এবং সুন্দরবন অঞ্চলকে ‘বাঙালা’ বলে তাদের নথিপত্রে লিখে গেছেন।
চন্দ্ররাজাদের সময় বাঙালার ভৌগলিক সীমারেখা বৃদ্ধি পায়। তখন থেকে সমগ্র দক্ষিণ বাঙালাই 'বাঙালা' নামে অভিহিত হতে থাকে। প্রাচীনকালে বাঙালা ও বঙ্গ নামে আলাদা দুটি রাষ্ট্র ছিল। বাঙালাকে "বাঙালা দেশ" নামে ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাওয়া যায়। বঙ্গ হচ্ছে বর্তমান পশ্চিম বঙ্গ এলাকা। এটা ‘গৌড়’ নামেও দীর্ঘকাল পরিচিত ছিল।
বাঙালা এবং বঙ্গকে সর্বপ্রথম একত্রিত করে একক রাষ্ট্রে পরিণত করেন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৭ ইসায়ি)। তারিখ-ই-ফিরোজশাহী রচয়িতা শামস-ই-সিরাজ আফিফ এজন্য শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে উপাধি দিয়েছিলেন 'শাহ-ই-বাঙালা', 'সুলতান-ই-বাঙালা' এবং 'শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান'। এই একক রাষ্ট্রের নাম হয় 'মুলুকে বাঙালাহ'। আরব বিশ্বে 'মুলুকে বাঙালাহ' একটি মর্যাদাবান, সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী এবং উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন বাঙালায় মুসলিম শাসন স্বাধীনভাবে ১৩৩৮ ইসায়ি থেকে শুরুর পর মুসলিম সমাজের ব্যাপক প্রসার হয়। কিন্তু ইতিহাসের তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, ইসলামের প্রথম শতক থেকেই বাঙালায় মুসলিম জনসমাজের বিস্তৃতি শুরু হয়েছে।
পাথর কিংবা পোড়ামাটিতে উৎকীর্ণ ক্যালিগ্রাফি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মারক এবং সমসাময়িক তথ্য উন্মোচনে ফলপ্রসু মাধ্যম। বাঙালায় রাজনৈতিকভাবে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয় ১২০৩ ইসায়িতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খালজির হাতে। এ সময় দিল্লীর সম্রাট ছিলেন কুতব উদ্দিন আইবেক। কিন্তু তারও বহু আগে বাঙালায় মুসলিম জনসমাজ ছিল। রাজা লক্ষণ সেনের দরবারে শেখ জালাল উদ্দিন তাবরেজী নামে একজন মুসলিম বিদ্বান ব্যক্তি সভাসদ ছিলেন। লক্ষণ সেনের আরেক সভা-পণ্ডিত হলায়ুধ মিশ্র রচিত 'শেখ শুভোদয়া'য় আমরা শেখ জালাল উদ্দিনের বর্ণনা দেখতে পাই। রাজসভায় একজন মুসলমান পণ্ডিত থাকার অর্থ হল রাজ্যে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠির বিদ্যমান থাকার প্রমাণ।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত বাঙালার উৎকীর্ণ লিপির সবচেয়ে প্রাচীন নমুনাটি হচ্ছে লালমনিরহাটের হারানো মসজিদ ইস্টকলিপি। পোড়ামাটির তৈরি ইটে উৎকীর্ণ করে কালেমা তৈয়্যবা এবং ৬৯ হিজরি লেখা হয়েছে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রাম। এখানেই আবিষ্কৃত ৬৯ হিজরিতে নির্মিত মসজিদটির সামনে ফসলের মাঠটি একদা ছিল চকচকার বিল। এলাকার প্রবীণ মানুষের কাছে স্থানটি আজও সাগরের ছড়া নামে পরিচিত, যার অনতিদূরে তিস্তা নদীর অবস্থান। ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম অববাহিকাগুলোর একটি। সুতরাং এই অববাহিকায় ৬৯ হিজরি বা ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘটনা বিস্ময় জাগানিয়া হলেও সেটা অস্বাভাবিক নয়। ব্রিটিশ প্রতœতাত্ত্বিক টিম স্টিল বলেন, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলজুড়ে যে প্রাচীন সভ্যতা খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে প্রাচীন রোমান ও আরব-সভ্যতার সম্পর্ক ইতিহাসের একটি স্বাভাবিক ঘটনা। সভ্যতার সঙ্গে সভ্যতার এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই আরব বণিকেরা লালমনিরহাটের ওই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করেন টিম স্টিল।
গবেষকরা ঐ ইস্টকলিপিতে তারিখের স্থলে একটি বিষয় এড়িয়ে গেছেন। "সানাত ১, ৬৯" অর্থাৎ বছরের ১ম মাস(মহররম), ৬৯ হিজরি। ৬৯১ ইসায়িতে মসজিদটি নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও ইস্টকলিপির সঠিক বয়স নির্ধারণে রাসায়নিক পরীক্ষার কথা জানা যায়নি। এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ্য, এর লিপি বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামের প্রথম শতকে যে লিপিসমূহ ছিল, বিশেষ করে ইরাক থেকে বাঙালার দিকে যে লিপি বিস্তৃতি লাভ করেছিল, তাকে 'খত আল বাহরি' বলা হয়। পরবর্তিতে একে বিহারী লিপি বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে। এ নামকরণের দুটো কারণ আমরা খুজে পাই। এক. সমূদ্রপথে এ লিপির খোদাই কারিগর ও লিপিকর বাঙালায় এসেছিলেন এবং সমূদ্রের ঢেউয়ের মত এলিপির গতিপ্রকৃতি ছিল। দুই. বাঙালার পশ্চিম-উত্তর অংশে বিহার এলাকায় পাথরে খোদাই ও পুথিপত্র রচনায় একদল ক্যালিগ্রাফার এ লিপিটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এজন্য স্থান নামের সাথে এর নামকরণ হয়েছে।
বর্তমান সময়ের ইরাকের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি গবেষক ইউসুফ জিন্নুনের মতে, সমুদ্র পথে এলিপির বাঙালায় আগমণ এবং উন্নতি সাধনের কারণেই একে 'খত আল বাহরি' নাম দেয়া হয়। খত আল বাহরি অর্থ- সমুদ্র লিপি।
আরেকটি বিষয় এলিপিটির আলিফের নিচের অংশ বামে একটু বেশি ঝুলানো। এ ধরণের আলিফকে বলা হয় "আলিফ মুশা'য়ার"। উৎকীর্ণ লিপিতে আলিফ মুশা'য়ার প্রয়োগ করা ইসলামের প্রথম শতকের লিপির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল।
গবেষকগনের মতে, বাঙালায় কালোপাথর (ব্লাক ব্যাসল্ট) বা বেলে পাথরে (স্যান্ড স্টোন) উৎকীর্ণ ক্যালিগ্রাফির নমুনা সমূহ সুলতানী আমল (১২০০ ইসায়ি) থেকে শুরু হয়েছে। বাঙালায় ইমারাতে ব্যবহৃত ব্লাক ব্যাসল্ট এসেছে ততকালিন বিহার এবং বর্তমানে ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাজমহলের কালো আগ্নেয়শিলা পাহাড় থেকে। আহমদ হাসান দানী তার মুসলিম আর্কিটেকচার ইন বেঙ্গাল গ্রন্থে লিখেছেন, মালদা জেলার রাজমহল পাহাড় থেকে ব্লাক ব্যাসল্ট আনা হত এবং কদাচিৎ বিহার থেকে স্যান্ড স্টোন এবং গ্রানাইট আনা হত। এছাড়া কখনও খোরাসান থেকে ব্লাক ব্যাসল্ট আনা হত বলেও ইতিহাসে পাওয়া যায়।
প্রশ্ন হল ইস্টক লিপি উৎকীর্ণের বিষয়টির সাথে ব্লাক ব্যাসল্ট ও স্যান্ড স্টোনের সম্পর্ক কী? বাঙালার মুসলিম শাসনের আগের কোন ব্লাক ব্যাসল্ট বা স্যান্ড স্টোনের ওপর আরবি ক্যালিগ্রাফির উৎকীর্ণ নমুনা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু এর থেকে প্রাচীন পোড়া মাটির ইট এবং তাতে উৎকীর্ণ লিপির নমুনা আছে।
বাঙালায় তুর্ক-আফগান শাসক এবং তাদের সাথে আগত পাথরে উৎকীর্ণ লেখা ও নকশা খোদাইয়ের দক্ষ শিল্পীরা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জীবন অতিবাহিত করেছেন। এজন্য সুলতানী আমল ও মোগল আমলের ইমারাতে তাদের শিল্পকর্মের বিস্তৃত নমুনা দেখা যায়।
১২০৫ থেকে ১৭০৭ ইসায়ি পর্যন্ত বাঙালায় পাথরে উৎকীর্ণ ইসলামী ক্যালিগ্রাফির সংখ্যা প্রায় ৪০০(চারশত)। সুলতানী আমলের প্রায় সবগুলি পাথরে উৎকীর্ণ ক্যালিগ্রাফি আরবিতে এবং মোগল আমলের অধিকাংশ ফার্সিতে লেখা। এসব ক্যালিগ্রাফি মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, মাজার, দরগাহ এবং কবরগাহে স্থাপন করা হয়। ক্যালিগ্রাফিতে কুরআনের আয়াত, হাদিস এবং সমসাময়িক অনেক তথ্য স্থান পায়। এটা সমসাময়িক সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক চিত্র অনুধাবনে যথেষ্ট সহায়ক। এবিষয়ে এখন গবেষণাকর্মও দেখা যায়।
রাজশাহীর সুলতানগঞ্জে প্রাচীন একটি সেতুতে বাঙালার দ্বিতীয় সুলতান আলাউদ্দিন ওয়াদ্দুনিয়া (আলি মর্দান খালজী, ১২১০-১২১৩ ইসায়ি) সময়ের ব্লাক ব্যাসল্টে উৎকীর্ণ ফার্সি ভাষায় ক্যালিগ্রাফি ফলক পাওয়া যায়। বর্তমানে এটি বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত। এর লিপি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গবেষক অধ্যাপক ইউসুফ সিদ্দিক বলেন, এটা তাওকি লিপি। এ প্রবন্ধ লেখকের মতে, এর খাড়া রেখা ও আনুভূমিক রেখার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে একে খত আল বাহরির স্থাপত্য সংস্করণ বললে অধিক যুক্তিযুক্ত হয়। প্রাচীন তাওকি লিপিতে শব্দের শেষ হরফের শেষাংশ বা লেজ পরবর্তী শব্দের প্রথম হরফের সাথে বিশেষ নিয়মে লেগে যায়। যেটা এ নমুনায় দেখা যায় না। অন্যদিকে আনুভূমিক রেখার শেষাংশ পুষ্ট হয়ে ঢেউয়ের মত ভাব দেখা যায় বাহরি লিপিতে। এ নমুনায় সেটা বেশ পাওয়া যায়। তিন লাইনের এ শিলালিপিতে লাইন বিভক্তি রেখা আছে। এতে জমিন খোদাই এবং হরফ উচু রাখা হয়েছে।
কালো পাথরে পলিশ(পৃষ্ঠদেশ মসৃণ করার পদ্ধতি) করলে কালো চকচকে ভাব আসে। এর ওপর খোদাই করলে, খোদাই অংশ ছাই রঙের সাদাটে ভাব হয়। হরফ খোদাই করলে অল্প সময়ের মধ্যে একটি নামফলক তৈরি করা যায়। কিন্তু সুলতানী আমলের প্রায় সবগুলো এবং মোগল আমলের অধিকাংশ পাথরে জমিন খোদাই করা হয়েছে, ফলে হরফ এবং বিভক্তি রেখা জমিন থেকে উচু হয়েছে। এটা বলা যত সহজ, হাতে করা ততটাই কঠিন। এ বিষয়টি চিন্তা করলে দক্ষতার উচ্চমান অনুধাবন করা যায়। পাথর খোদাই কাজ দুটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। প্রথমে একজন ক্যালিগ্রাফার পুরো লেখাটি(টেক্সট) পাথরে কালি বা সিসার কলম দিয়ে একে দেন, তারপর উস্তাদ খোদাইকার ছেনি (খোদাই করা লোহার ছোট বাটালি ধরণের যন্ত্র) দিয়ে হরফের আউট লাইন বের করে দেন, একে কাটাই বলে। দ্বিতীয় পর্যায়ে হরফের আউটলাইন ধরে জমিনকে ৫ থেকে ৮ মিলিমিটার পর্যন্ত খোদাই করে একজন সাগরেদ বা নবিশ খোদাইকার। একে চটানো বলে। খোদাই কাজে ওস্তাদ খোদাইকারের ওপরই ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্যের মান রক্ষার দায়িত্ব বর্তায়। আর এটা দু'এক বছরে অর্জন করা সম্ভব নয়। বাঙালার সুলতানী আমলের মাঝামাঝি সময় থেকে খোদাই দক্ষতা অসাধারণ পর্যায় পৌছেছিল। কিছু কিছু নমুনায় যিনি টেক্সট একেছেন তিনিই খোদাই করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
পশ্চিম বঙ্গের বিরভুমের সিয়ানে একটি খানকায় সুলতান গিয়াস উদ্দিন ইওদ খালজীর (১২২১ ইসায়ি) সময়ের একটি নামফলক পাওয়া গেছে। যেটার লিপিশৈলিতে তেমন পার্থক্য নেই সুলতানগঞ্জের শিলালিপি থেকে।
রাজশাহীর নওহাটায় একটি অজ্ঞাতনামা মসজিদ ও মাদ্রাসা থেকে বিদ্রোহী খালজী সেনা নায়ক বলাকা খানের (১২২৯-১২৩০ ইসায়ি) সময়ের একটি শিলালিপি উদ্ধার করা হয়। বরেন্দ্র জাদুঘরে বর্তমানে সেটি সংরক্ষিত। লিপির ভাষা ফারসি। লিপি শৈলি সম্পর্কে সুষ্পষ্ট কোন মন্তব্য কেউ করেননি, তাওকি ও সুলুস লিপির মিশ্রন বলে অনেকে মত দিয়েছেন। এ প্রবন্ধ লেখকের মতে, পূর্বের শিলালিপি দুটি থেকে এর বিশেষ পার্থক্য হচ্ছে, উৎকীর্ণ বাহরি লিপির এটি একটি বলিষ্ঠ নমুনা। আলিফ মুশা'য়ার এবং আলিফ মুরাক্কাব বা আলিফ নেহাইয়্যাহ(হরফের সাথে মিলিত আলিফ)সহ ত্বয়া, কাফ, লামের আলিফের(খাড়া রেখা) মাথায় ডানদিকে নিশানাকৃতির জুলফ(আকশির মত তিনকোনা পতাকা) বিজয় অনুভব এবং আনুভূমিক হরফের শেষ প্রান্ত বাহরি লিপির পূর্ণ বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে। এতেও জমিন খোদাই(রিভার্স খোদাই) করা হয়েছে। আয়তাকার প্যানেলের এধরণের কাজ তুর্কি ধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ শিলালিপির ক্যালিগ্রাফার এবং খোদাইকার তুর্কি বংশোদ্ভুত বা ঐ ধারার কাজ সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল বলে অনুমান করা যায়। এ শিলালিপির মিম মুরাক্কাব আউয়াল(মিলিত প্রথম মিম) মাথার শুরু এবং শেষ সংযুক্ত নয়। জিমের মাথার(র'স) প্রথমাংশ বৃত্তাকার ও ভারি। কাফ মুরাক্কাবের আলিফের পেট বা বুক বরাবর ডানপাশে আল সুওবানি(অজগরাকৃতি রেখা) শিলালিপিটিকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। এ তিনটি শিলালিপির আলোচনা থেকে খালজী শাসনামলের (১২০৩-১২৩০) ক্যালিগ্রাফির শৈলি বিষয়ক একটি চিত্র পাওয়া যায়। স্থাপত্যে বাহরি লিপির প্রয়োগ এবং এর দ্রুত উন্নয়নে ক্যালিগ্রাফার ও খোদাইকারের আন্তরিকতা এবং নিপুনতা অর্জনে একনিষ্ঠতা প্রশংসনীয়।
ইলিয়াসশাহী (১৩৪২-১৪৮৭ ইসায়ি) শিলালিপিতে খাটি আরবি শৈলিতে ফিরে যাওয়ার একটি প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। সুলুস লিপির অসাধারণ প্রয়োগ হয়েছে এসময়। হাদরাত পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ ক্যালিগ্রাফি (১৩৭৪ ইসায়ি) সুলুস লিপির অন্যতম সেরা উদাহরণ। মিহরাবে, দেয়ালে ক্যালিগ্রাফির সাথে ফুলেল অলংকরণের ব্যবহার আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে একে। মিহরাবে উৎকীর্ণ সুলুস লিপিটির নান্দনিক রূপ-সৌন্দর্য সমসাময়িক তুর্কি সুলুস লিপির সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। তবে মসজিদের অন্য দেয়ালে উৎকীর্ণ সুলুস লিপিতে বেশ পার্থক্য আছে। এতে ধারণা হয়, মসজিদটিতে একাধিক ক্যালিগ্রাফার কাজ করেছেন। মসজিদে মহিলা নামাজীদের প্রবেশদ্বারের উপরে কালিমা তৈয়্যবার সুলুস শৈলির কম্পোজিশনটি বাঙালায় মধ্যযুগের উৎকীর্ণ ক্যালিগ্রাফির অন্যতম সেরা কাজ।
অন্যদিকে নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে গাজীপীরের মাজার থেকে প্রাপ্ত শিলালিপিটি সুলুস শৈলি ভেঙ্গে তুগরায় রূপান্তর বলা যায়। খাড়া হরফের মাথাগুলো মোটা আর ভারি। বাশের বেড়ার মত হরফের খাড়া রেখার বুক ও পেট বরাবর কাফ হরফের সুওবান আর ফি, নুন দিয়ে বন্ধন সৃষ্টি। নিচে হরফের কম্পোজিশন দিওয়ানী লিপির তলোয়ার কম্পোজিশন সদৃশ করা হয়েছে। এটা তুর্কি ধারার বাঙালা সংস্করণ বলা যায়। এধরণের কাজ থেকে বেংগল তুগরার স্বকীয় ধারা বিকশিত হয়। সুলতান আহমদ শাহ(১৪৩২-১৪৪১ ইসায়ি) সময়ের শিলালিপি এটি।
গৌড়ের চান্দ দরওয়াজা শিলালিপিটি বারবাক শাহের(১৪৬৬-১৪৬৭ ইসায়ি) সময়ের। তুগরার অসাধারণ একটি নমুনা এটি। খাড়া আয়তন বিশিষ্ট দুই সারি ঘরগুলোতে চমৎকার তুগরা করা হয়েছে। চারপাশে বর্ডারে সুলুস লিপি এবং শামসি (সূর্য) সদৃশ ফুল দিয়ে অলঙ্করণ করা হয়েছে। এটি সমসাময়িক ক্যালিগ্রাফির একটি সেরা কাজ।
সুলতানী আমলের শেষদিকে মাহমুদ শাহের (১৫৩৪-১৫৩৫ ইসায়ি) সময়ের একটি অজ্ঞাতনামা শিলালিপির ছবিতে দেখা যায় সুলুস লিপিকে চমৎকার করে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এসময় পোড়া মাটির ফলকে সুলুস লিপির কিছু কাজ হয়েছে। সুলতানী আমলের ক্যালিগ্রাফি ছিল পরিপূর্ণ আরবি লিপি শৈলিতে প্রত্যাবর্তনের একটা প্রচেষ্টা। এসময়ে ভাষাগত বিষয়টি ফারসীর পাশাপাশি আরবির প্রতি বিশেষ টান পরিলক্ষিত হয়। সুলতানি আমলে প্রচুর মসজিদ ও মাদ্রাসা একসাথে গড়ে ওঠে এবং বিশুদ্ধ আরবি চর্চার দিকে মনোনিবেশ করতে দেখা যায়। সুলুস লিপি হচ্ছে আরবি লিপিশৈলির মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাবান এবং নান্দনিক শৈলি। বাঙালার স্বাধীন সুলতানগণ যথার্থই ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্যবোধের সমঝদার ছিলেন এবং সেরা শৈলিটিরই প্রসার ও উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন।
মোগল শাসকরা (১৫৭৬-১৭৫৭ ইসায়ী) শিয়া প্রভাবিত ছিলেন। ফারসি ভাষার মত ফার্সি লিপি নাস্তালিক লিপির প্রতি তাদের আকর্ষণ ছিল প্রায় প্রশ্নাতীত। এজন্য সুলতানী আমলের ক্যালিগ্রাফার ও খোদাইকারদের একটি বৃহদাংশ বিপাকে পড়েন। এসময় বাঙালার উৎকীর্ণ লিপিতে একটি জগাখিচুড়ি অবস্থা দেখা যায়। সামান্য সংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া আরবি মিশ্রিত ফারসি শিলালিপিতে সৌন্দর্য বলতে তেমন কিছু ছিল না। তবে কিছুকালের মধ্যে ইরান থেকে লিপি শিল্পী ও খোদাইকারদের বাঙালায় আগমন ঘটে এবং নাস্তালিক লিপি দিয়ে চমৎকার সব নামফলক তৈরি হতে থাকে। নামফলকে কুরআন-হাদিসের বাণী বাদ দিয়ে ফার্সি কবিতার ছত্র জায়গা করে নেয়। মাজারগুলো পুজার আখড়ায় পরিণত হয়। নানা নামে-বেনামে অসংখ্য পীর-আওলিয়ার মাজারের উদ্ভব ও ইমামবাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়। মোগলরা বাঙালায় শাসন ক্ষমতা দখল করে ইসলামী আকিদা ও তমুদ্দুনের তরীটি ডুবিয়ে দেয়। আরবি ক্যালিগ্রাফির জৌলুস নিভিয়ে ফার্সি ক্যালিগ্রাফির নিশান উড়ায়।
ফার্সি ক্যালিগ্রাফারদের 'শিরিন দাস্ত' 'জরীন দাস্ত' উপাধী আর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়। এসময় গুলজারের মত কিছু ফার্সি লিপি বাঙালায় ছড়িয়ে পড়ে। কুরআন লেখায়ও এর বেশ প্রভাব পড়ে। ইরানী নাশখ লিপিতে অনেক কুরআনের কপি করা হয়। মোগল আমলের নামকরা কিছু ক্যালিগ্রাফারের উল্লেখ ইতিহাসে পাওয়া গেলেও সুলতানী আমলের ক্যালিগ্রাফারদের প্রায় সবাই ইতিহাস থেকে নিচিহ্ন হয়ে গেছেন।
বাঙালার প্রাচীন ক্যালিগ্রাফির লিপিকর, খোদাইকারদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখন পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফির নমুনা পর্যালোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে এর শৈল্পিক মূল্যায়ন হতে পারে। এটা করা সম্ভব হলে সমসাময়িক শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে এবং এর ঐতিহ্যধারার পথ বের করা সহজ হবে।
বিশ্বে ইসলামী স্থাপত্যকলায় বাঙালার যে বিশাল অবদান, বিশেষ করে ক্যালিগ্রাফিতে, তা ব্যাপকভাবে গবেষণার দাবি রাখে। -মোহাম্মদআবদুর রহীম
##