জুমাবারের ক্লাসে আজ গোপালগঞ্জ থেকে এক ছাত্র এসেছিল, ক্লাস শেষে আবার সেখানে চলে যাবে। আরেকজন মেহমান ছিলেন এ্যাডভান্স হ্যান্ড রাইটিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক দিলিপ স্যার। তিনি আমার খোঁজ পেয়েছেন কলকাতার আহমদ হ্যান্ড রাইটিংয়ের কাছ থেকে, তিনি ফোন দিয়ে ক্লাসে চলে আসলেন। কলকাতাসহ বাংলাদেশে তার কয়েকটি শাখা আছে হাতের লেখা সুন্দর করে শেখার। তার সাথে আলাপে অনেক বিষয় খোলাশা হল। তারা কী শেখান, কিভাবে শেখান, কেন শেখান, শেখাতে কত ফি নেন ইত্যাদি। তিনি আমার কাছ থেকে আমাদের ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত অনেক কিছু জানলেন।
হ্যান্ড রাইটিং সুন্দর করার যেসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আছে, সেগুলো প্রধানত স্কুলের বাচ্চাদের হাতের লেখা দ্রুত এবং সুন্দর কিভাবে করা যায়, তা শিখিয়ে থাকে। পরীক্ষায় হাতের লেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ভাল হাতের লেখার খাতা বরাবরই বেশি নম্বর পেয়ে থাকে, পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে সুন্দর হাতের লেখার ছাত্রটি জীবনে সফল হয় অনায়াসে। তাই অভিবাবকগণ সব সময় এই দিকটিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। হাতের লেখা সুন্দর করার প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন পদ্ধতি নিজেদের মত বানিয়ে বাচ্চাদের লেখার তালিম দিয়ে থাকে। এই প্রশিক্ষকদের অধিকাংশই হাতের লেখা বিষয়ে কোন সনদধারী না হয়েও নিজের হাতের লেখা সুন্দর এবং অভিবাবকদের কনভিন্স করে প্রশিক্ষণ ক্লাসে বাচ্চা ভর্তি করে থাকেন। বাংলাদেশের সিংহভাগ শিক্ষিত লোকের বাজে হাতের লেখা এবং প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে একে গুরুত্বহীন রাখা হয়েছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবহেলার শিকার হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজ্ঞতা কিংবা খামখেয়ালির কারণে।
হ্যান্ড রাইটিং শেখানোর বিষয়ে কেউ লেখা না জানা ব্যক্তি/বাচ্চাকে সেটা শেখান এবং লেখা সুন্দরের কৌশল দেখিয়ে দেন কিংবা বাজে হাতের লেখাকে কেউ শুধরানো ও সুন্দর করার কৌশল শেখান, এর জন্য প্রশিক্ষককে শিল্পী হওয়া আবশ্যক নয়, শুধু কায়দাটা জানা থাকলেই চলে। তবে শিল্পী হলে ছাত্রের জন্য বেশি সুবিধা হয়। হাতের লেখা শেখানোর পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটা পদ্ধতি দিলিপ স্যার ’ডি মেথড’ নাম দিয়েছেন, এটাতে একটি খাড়া রেখা ও সমতল রেখার পরস্পর ছেদ করে যে যোগ চিহ্ন হয়, সেটাকে সীমানা ধরে সব হরফ লেখা এবং হরফের ঘাত রেখা (একবারে যতটুকু লেখা যায়) চিহ্নিত করা হয়। হরফ লেখায় কোন রেখাটি ক্রমানুসারে লিখতে হবে এবং সেটা অবস্থান ও সীমা, এ পদ্ধতিতে তিনি দেখিয়ে থাকেন, পদ্ধতিটি একান্তই তার নিজের করা। এই লেখা শেখার উপকরণ একেবারেই সাধারণ ও সহজলভ্য ও দামে সস্তা। যেকোন বল পয়েন্ট কলম বা কালি বা জেল কলম আর সাদা অথবা রুল টানা কাগজ হলেই চলে।
ক্যালিগ্রাফি মূলত শিল্প সম্মত হরফের চিত্র। সুতরাং এতে শিল্পকলার বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত। উপায় ও উপকরণ নির্দিষ্ট ও তা আর্টের দোকানগুলোতে পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে সুন্দর হাতের লেখা শেখার পর তা কিভাবে শিল্পে রূপলাভ করবে সেটার প্রশিক্ষণ দেয়ার নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশে। চারুকলার প্রাচ্যকলা, গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ এবং বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি ফাউন্ডেশন ক্যালিগ্রাফি শিখিয়ে থাকে। ট্রেডিশনাল ও পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফির প্রশিক্ষণ একমাত্র বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি ফাউন্ডেশন শিখিয়ে থাকে। প্রাচ্যকলায় পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফি এবং গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে টাইপোগ্রাফি শেখায়। এছাড়া অনিয়মিতভাবে পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফির কিছু ওয়ার্কশপ হয়ে থাকে। কিছুদিন আগে শিল্পী মাহবুব মুর্শিদ ঢাকায় একটি ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং ওয়ার্কশপের আয়োজন করেন। বাংলাদেশ চারুশিল্পী পরিষদ আরেকটি ক্যালিগ্রাফির ট্রেডিশনাল ও পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফি ওয়ার্কশপের ঘোষণা দিয়েছে। ঢাকার গুলশানে সেটা হবে।
ক্যালিগ্রাফি ট্রেডিশনাল পদ্ধতিতে শেখার জন্য “কত্ বা নোকতা পদ্ধতি” আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত ও স্বীকৃত। এটা মুসলমানদের একান্ত আবিস্কার ও ঐতিহ্য। হাজার বছর ধরে এ পদ্ধতিতে ক্যালিগ্রাফি শেখানো হচ্ছে। বাংলা ক্যালিগ্রাফির ট্রেডিশনাল ধারাটিও এ পদ্ধতিতে শেখানো হয়। এর সাথে হরফকে নান্দনিক বা লাবণ্যযোজন করা হয় বৃত্ত পদ্ধতি এবং সাদৃশ্য পদ্ধতি প্রয়োগে। শিল্পের ষড়ঙ্গ যেটা প্রাচ্যকলায় একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়, তা ক্যালিগ্রাফিতেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং ক্যালিগ্রাফি শিখতে হলে আপনাকে একজন ক্যালিগ্রাফার ওস্তাদ খুজে বের করতে হবে এবং আপনাকে যথেষ্ট সময়, পরিশ্রম ও সাধনা করতে হবে। ক্যালিগ্রাফার হওয়ার কোন সর্টকার্ট রাস্তা নেই। ভাল হাতের লেখা শিখে আপনি জীবন যাপনে সুবিধা পাবেন আর ক্যালিগ্রাফি শিখে আপনি শিল্পী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবেন এবং এলিট শ্রেণির সম্মান লাভ হবে। শিল্পের যে তৃষ্ণা, তা আপনি মেটাতে পারবেন ক্যালিগ্রাফি শিখে। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একজন ক্যালিগ্রাফারের যে খ্যাতি তা আপনাকে অভিভূত করবে, যখন আপনি একজন ক্যালিগ্রাফার হবেন।
No comments:
Post a Comment