Sunday, September 27, 2015

হাসান চালাবি : ২০ শতকের ইসলামি ক্যালিগ্রাফির মহান সংস্কারক






সাক্ষাতকার


সাক্ষাতকার গ্রহণ- সোরাইয়া সাইয়েদ
ইসলামিকা ম্যাগাজিন, ইস্যু ১১, ২০০২

অনুবাদ- মোহাম্মদ আবদুর রহীম*





ওস্তাদ হাসান চালাবি

এটা বেশি দিন আগের কথা নয়, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন এবং ১৯২৩ সালে তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ফলে রাষ্ট্রধর্ম থেকে ইসলামের বিদায় এবং লিপি হিসেবে আরবি বর্ণমালাকে সরিয়ে লাতিন হরফকে প্রতিস্থাপন করা হয়। এটা তুরস্কে ইসলামি ক্যালিগ্রাফি এবং ক্যালিগ্রাফারদের জন্য একটি মহাবিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাড়ায়। প্রবীন ক্যালিগ্রাফারদের মৃত্যু এবং দ্রুত ইসলামী ক্যালিগ্রাফির প্রতি জনগণের আগ্রহ কমে আসে। এসময় ধারণা করা হয়, এই মহান শিল্পটি হয়ত চিরকালের জন্য তুরস্ক থেকে হারিয়ে যাবে। এ সংকটময় পরিস্থিতিতে ১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন হাসান চালাবি। গত শতাব্দিতে তিনি ছিলেন ইসলামি ক্যালিগ্রাফির পুনর্জীবনের মহানায়ক। তুরস্কের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে একটি ছোট্ট গ্রাম এরজুরুম। সেখান থেকে হাসান চালাবি তার ক্যালিগ্রাফির যাত্রা শুরু করেন। তার ক্যালিগ্রাফি এখন পবিত্র মসজিদুন্নববির দেয়ালে শোভা বর্ধন করছে। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন নামকরা মসজিদে তার ক্যালিগ্রাফি রয়েছে। যৌবনকালে তিনি নিজ শহর ত্যাগ করে ইস্তাম্বুলে এসে কুরআন অধ্যয়ন, মুখস্তকরন এবং ইমামের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। বর্তমানে ইস্তাম্বুলের ইয়েস্কুদারে বসবাস করছেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার কাছে ক্যালিগ্রাফি শিখতে ছাত্ররা আসে।

রাব্বি ইয়াসসির ওলা তুয়াস্সির রাব্বি অতামমিম বিল খাইর, সুলুস লিপি

সোরাইয়া সাইয়েদ : কোন বিষয় আপনাকে ইসলামি ক্যালিগ্রাফি অধ্যয়নে আগ্রহী করে তুলল?
হাসান চালাবি : শৈশব থেকে কলম এবং কাগজ আমাকে প্রচন্ডভাবে মুগ্ধ করে রাখত। আমি ভেবে পাইনা, এটার প্রতি ভালবাসা কোত্থেকে এল। এই ভালবাসার টানই আমাকে ইসলামি ক্যালিগ্রাফির মরুপ্রান্তরে এনে ফেলেছে।

সোরাইয়া সাইয়েদ : একজন ক্যালিগ্রাফার হয়ে ওঠার সময়ে প্রশিক্ষন গ্রহণকালে কোন ঘটনা আপনার স্মৃতিতে উজ্জল হয়ে আছে?
হাসান চালাবি : ওস্তাদের কাছে একজন ক্যালিগ্রাফির ছাত্র কোন বিষয়টি একান্তভাবে চান? সেটা হচ্ছে, মশক অর্থাৎ অনুশীলন খাতায় উস্তাদের স্বীকৃতি। আমার সবচেয়ে সুখকর সময় ছিল, যখন আমার বাড়ীর কাজগুলোতে উস্তাদ স্বীকৃতি দেন। কিন্তু সেটা সহজ ছিল না। তিনি ছিলেন অন্তরমুখি মানুষ। তিনি আমার মশকগুলো শুধরে দিতেন কলম দিয়ে কিন্তু কখনই বলতেন না যে আমি পাশ করেছি কিনা, আর পরবর্তি পাঠে যাবো কিনা। এটা আমাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে রাখত। অবশেষে আমি নিজের জন্য একটা উপায় বের করি, যদি কোন পাঠে তিন বা তার কম ভুল ধরা পড়ে তাহলে আমি পাশ করেছি পরবর্তি পাঠে যাওয়ার জন্য। আর যদি চার বা ততোধিক ভুল ধরা পড়ে তাহলে সেটা ফেল হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং আমাকে পাঠটি পুনরায় করতে হবে। আর এভাবেই আমার পাঠ এগিয়ে যাচ্ছিল। এক অথবা দু’সপ্তাহের মধ্যে আমার একেকটা পাঠ পাশ করে পরবর্তি পাঠে যাচ্ছি। কিন্তু হরফ ’সিন’ পাঠে দুই মাস লেগে গেল অথচ পাশ করতে পারছি না। আমাদের ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষায় উস্তাদের কাছে প্রশ্ন করা বেয়াদপি, তাই চুপ থাকতাম পাঠ শুধরানোর সময়। যদি উস্তাদ আগে কিছু জিজ্ঞাসা করেন, তখনই ছাত্র প্রশ্ন করতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওস্তাদের কাছে হরফ সিন বিষয়ে জানতে চাইলাম.. কেন বার বার আমার একই ভুল হচ্ছে। তিনি আমাকে কিছু পরামর্শ দিলেন। আর আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, পরের সপ্তায় আমি পাশ করে গেলাম। এটাই আমার শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি।

আমার উস্তাদ ফেরহাত কারলু এবং দাদা উস্তাদ হাসান চালাবি


সোরাইয়া সাইয়েদ : আপনার ওস্তাদ হামিদ আইতাকের সাথে কোন স্মৃতিটি মনে পড়ে?
হাসান চালাবি : একটি মসজিদে ওস্তাদ মুস্তাফা ইফেন্দির একখানা ক্যালিগ্রাফি ছিল, সেটার কালি মলিন ও অস্পষ্ট হয়ে গেছিল। আমাকে সেটা পুণ:লিখনের জন্য বলা হল। ঐ ক্যালিগ্রাফিটি লিখে দেয়া আমার জন্য ছিল অত্যন্ত জটিল বিষয়। তখনও আমি ইযাযা অর্থাৎ ক্যালিগ্রাফির সনদপত্র পাইনি। পুরো একটি সপ্তাহ পার হয়ে গেল আমার দুশ্চিন্তায় যে, কিভাবে এটি আমি পুন:মেরামত করব। যখন আমি ভাবছিলাম এটা আমি করতে পারব কিনা, এসময় একটা স্বপ্ন দেখলাম। মুস্তাফা ইফেন্দি এবং হামিদ আইতাক একসাথে একটি ক্যালিগ্রাফি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। মুস্তফা ইফেন্দি ছিলেন পাগড়ি পরা, দেহে ছোট-খাট কিন্তু গাট্টা-গোট্টা, যেন একজন কুস্তি পালোয়ান। আমার উপস্থিতি তিনি টের পেয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন, “বেটা! এটা তুমি পারবে, এটা তোমার দ্বারা করা সম্ভব।”  আমি কখনই এই স্বপ্ন ভুলিনি এবং আমাকে ও আমার উস্তাদ হামিদ আইতাককে এটা কতটা খুশি করে ছিল। যখন আমি ওস্তাদের কাছে এই স্বপ্নের বর্ননা দিচ্ছিলাম, তিনি তা শুনে অঝোরে কাদছিলেন। এটা আমাকে এতটাই আবিষ্ট করেছিল। আমি কখনও এটা ভুলব না।


সোরাইয়া সাইয়েদ : আপনার ছাত্রদের প্রতি শিক্ষাদানে ওস্তাদ হামিদ আইতাকের শিক্ষা পদ্ধতির প্রভাব কতটা পড়েছে?
হাসান চালাবি : আমার শিক্ষাদান পদ্ধতিতে নিজ ওস্তাদের প্রভাব খুব কম। হামিদ বে ছাত্র পড়ানোতে অধিক মনোযোগ দিতে পারেননি। আমার মতে, এটা দু’টো কারণে ঘটেছিল। এক. যখন আমি তার কাছে পাঠ গ্রহণ করি, তখন তিনি ছিলেন বয়োবৃদ্ধ। এই এখন আমার যে বয়স ৬৭ বছর। এখন আমি সামর্থ অনুযায়ী যেভাবে পাঠ দান করি। তিনি তখন সেভাবে দিতেন। দুই. ওস্তাদ হামিদ ঐতিহ্যবাহী  মশক পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি মূলত: পূর্ববর্তী  ওস্তাদগণের কাজগুলো গভীর পর্যবেক্ষণ করে ক্যালিগ্রাফিতে ওস্তাদ হয়ে ওঠেন। আমি তার কলম চালনা এবং হাতের গতিপ্রকৃতি দেখে ক্যালিগ্রাফি শিখেছি। প্রথমদিকে তিনি আমাকে ক্যালিগ্রাফি শেখাতে চাননি, আমার পিড়াপিড়িতে  শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হন এবং সবসময় তার শিক্ষাদানের কথা আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।

সোরাইয়া সাইয়েদ : শিক্ষানবিশ থেকে ওস্তাদ ক্যালিগ্রাফার হওয়ার পথে এটা কি আপনার বিশেষ অভিজ্ঞতা নয়?
হাসান চালাবি : অবশ্যই এটা আমার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। আমার শিক্ষাগ্রহণের আগের জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু মনে নেই। শিক্ষাগ্রহণকালে আমি বিভিন্ন মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করছিলাম। দুটো কাজই অত্যন্ত দায়িত্বপরায়ন বিষয়। যদিও আমি ভাবি, কখনও ক্যালিগ্রাফি মনকে কিছু একটা দেয়, এটা আপনাকে শান্ত হতে এবং চারপাশের মানুষ থেকে আপনাকে বিশিষ্ট্যতা দান করে এবং আপনার ইতিবাচক মনোভাব পরিবর্তনে সহায়তা করে।


সোরাইয়া সাইয়েদ : একজন ওস্তাদ ক্যালিগ্রাফার হতে কি কি বিষয় দরকারী?
হাসান চালাবি : প্রথমেই প্রয়োজনীয় উপাদানটি হচ্ছে, ক্যালিগ্রাফি শিল্পের প্রতি ভালবাসা। দক্ষতা অর্জনের আগে চাই ভালবাসা। যদি কেউ ইসলামি ক্যালিগ্রাফিকে ভাল না বাসেন, তার পক্ষে কখনই এতে সফলকাম হওয়া সম্ভব নয়। এখন, এই বয়সে আমি লাতিন হরফে ক্যালিগ্রাফি করতে পারি না আমার হাত খুব কাপে বলে। কোন বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠার অধিক একনাগাড়ে পড়তে পারিনা, আমার ঘুম এসে যায়। কিন্তু ইসলামি ক্যালিগ্রাফির বেলায় হাত স্থির থাকে এবং এক নাগাড়ে ১০ ঘন্টা এবিষয়ের বইপত্র অধ্যয়ন করতে পারি কোন ক্লান্তিবোধ ছাড়াই। কারণ এটা আমি ভালবাসি। এছাড়া ওস্তাদ হতে অবশ্যই ধৈর্য্য প্রয়োজন। একজন ভাল ওস্তাদও প্রয়োজন আর প্রয়োজন কাজের সহায়ক পরিবেশ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রতিদিন একজন শিক্ষানবিশ ক্যালিগ্রাফারকে প্রচুর অনুশীলন করতে হবে। আমি ছাত্রদের বলি, প্রতিদিন ৩০ ঘন্টা! মশক করতে হবে।

সোরাইয়া সাইয়েদ : ক্যালিগ্রাফিতে ওসমানীয় ওস্তাদদের বিশেষ অবদান কি?
হাসান চালাবি : ক্যালিগ্রাফি শিক্ষাপদ্ধতিতে ওসমানীয় ক্যালিগ্রাফারদের প্রবর্তিত ও প্রতিষ্ঠিত রীতির ফলে আজ ইসলামি ক্যালিগ্রাফির এই উচ্চাসন আপনি দেখছেন। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের প্রতি মর্যাদাবোধ ও এর সাথে সংযুক্ত থেকে এর চর্চা অব্যাহত রাখা উচিত। এই শিল্পের বিশুব্ধ আকার-আকৃতি ও সৌন্দর্যবোধকে সংরক্ষণের মাধ্যমে একে আরও উচু স্তরে নেয়া সম্ভব।

সোরাইয়া সাইয়েদ : কোন বিষয়টি ছাত্র এবং ওস্তাদের মাঝে বিশেষ বন্ধনে আবদ্ধ করে থাকে?
হাসান চালাবি : সাধারণত, মশক পদ্ধতি অনুসরণ ছাড়া একজন ব্যক্তি ক্যালিগ্রাফির ওস্তাদ হতে পারেন না। একজন ছাত্র যতই মেধাবি হোন না কেন, তিনি ওস্তাদের সাহায্য ছাড়া কখনই শীর্ষস্তরে পৌছাতে পারবেন না। আমাদের ইসলামি ক্যালিগ্রাফির পরিমাপ পদ্ধতিটি বিশদ বর্ণিত। এটা অনুবীক্ষণিক, একজন পরিশিক্ষীত চোখের কাছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র  বিষয় যেমন মশার পায়ের অংশ বড় হয়ে দেখা যায়, কিন্তু এর কলিজা আরও ক্ষুদ্র তা নজর এড়িয়ে যায়, তাই হরফের লাইনের সুক্ষ্ম পরিবর্তনও নান্দনিকতা হারায়। একজন মেধাবি হয়ত একটি ক্যালিগ্রাফি হবহু নকল করলেন কিন্তু মশা বা মাছির কলিজাসম অংশ তিনি ভুল করবেন আর সেটাই সৌন্দর্য। সেখানে তিনি ব্যর্থ হবেন। কিন্তু একজন ওস্তাদ মুহূর্তের মধ্যে সেই ভুল ধরে ফেলবেন। সুতরাং ওস্তাদের সাহায্য ছাড়া সুক্ষাতিসুক্ষ নান্দনিকতা আয়ত্ব করা দুরহ কাজ। হয়ত ওস্তাদের সাহায্য ছাড়া তা আপনি আয়ত্ব করতে পারেন এজন্য আপনাকে বহু বছর কঠিন পরিশ্রম আর অধ্যাবসায় করতে হবে। তুর্কিতে একটি প্রবাদ আছে, “ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে একটি লোহার দানা(আসলেই অনেক কঠিন), ওস্তাদের পাঠদানের মাধ্যমে তা আপনার কাছে মোমের মত নরম হয়ে যাবে।”


সোরাইয়া সাইয়েদ : তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলায় ইসলামি ক্যালিগ্রাফির ভূমিকা কি?
হাসান চালাবি : ইসলামি ক্যালিগ্রাফির ভুমিকা এখানে মৌলিক পর্যায়ের। হরফের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কারণে অধিকাংশ শিল্প ভুক্তভুগী। নকশাকলা সরাসরি ক্যালিগ্রাফির সাথে সম্পর্কযুক্ত। দুটো শিল্প একসাথে চলে। ইসলামি ক্যালিগ্রাফিকে নগ্ন দেহের সাথে তুলনা করলে নকশাকলা হচ্ছে কাপড়ের মত। নকশাকলা দিয়ে ক্যালিগ্রাফিকে সুন্দর ও মনোরম করা হয়। ক্যালিগ্রাফিকে বাদ দিলে নকশাকলা হয়ে পড়ে জৌলুসহীন। সুতরাং এই শিল্পদ্বয় উন্নত হলে, সিরামিক ও মারবেলিং শিল্প বেড়ে ওঠে। মাত্র ২০ বছর আগেও  সংবাদ মাধ্যমে এ ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার দেখা অসম্ভব ছিল। বিশেষ অনুরোধের প্রয়োজন তখন ছিল একটু প্রচার প্রচারণার। কিন্তু আজ সেটা দরকার নেই। এখন এই শিল্প এতটাই শক্তিশালী ও চিত্তাকর্ষক যে মিডিয়ায় তা অনায়াসে প্রচার পাচ্ছে।

সোরাইয়া সাইয়েদ : খত শব্দটিকে ইসলামি অথবা আরবি ক্যালিগ্রাফিতে একটু ব্যাখ্যা করবেন?
হাসান চালাবি : খত হচ্ছে একটি সাধারণ শব্দ। একটি ফোটা থেকে রেখার শুরু এবং রেখা বা লাইনের গতি প্রকৃতি পরিবর্তন করে আপনি একটি হরফ পেতে পারেন। একে আপনি খত বলতে পারেন।
 “আরবি ক্যালিগ্রাফি” বা “খত আল-আরাবি” থেকে আমি “খত আল-ইসলামি” ব্যবহারের পক্ষে। কিন্তু আরবরা এটা সমর্থন করেন না। আমরা যখন একত্রিত হই, তারা এই শিরনাম মেনে নিতে চান না। আমি তাদের বলেছি- আমাদের বলা উচিত-“খত আল-ইসলামি”। কারণ “খত আল-আরাবি” কথাটি, এটাই বলছে যে এটা আরবদের আর্ট, অনারবরা এর চর্চা করতে পারেন না। এতে অনারবদের অধিকার নেই। পাকিস্তানি, আফগানি, ইরানি, তুর্কি, মরোক্কানরা আরব নয়, তাদের স্বীকৃতি এতে নেই! কিন্তু আমরা ক্যালিগ্রাফি কর্মের এবং শিল্পচর্চার বিষয়টি অস্বীকার করতে পারি না। তাই একে “খত আল-ইসলামী” বা “ইসলামি ক্যালিগ্রাফি” বললে সব দেশ-জাতি অন্তরভূক্ত হয়ে যায়।


সোরাইয়া সাইয়েদ : কিভাবে ওসমানীয়-তুর্কি ক্যালিগ্রাফি শৈলি আরব শৈলি থেকে বিশিষ্ট্যতা অর্জন করেছে?
হাসান চালাবি : ইসলামি ক্যালিগ্রাফিতে নান্দনিক চর্চায় আরব ও তুর্কিদের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। ওসমানীয় তুর্কিরা কুরআন ও হাদিসের বাণীকে আর্ট ফর্মে উন্নীত করতে সবিশেষ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ করেছে এবং এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে আরবরা এই বাণীকে তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগের প্রয়াস চালিয়েছে। তাদের মধ্যে প্রচুর মেধাবি থাকা সত্বেও তারা একে আর্ট ফর্মে উন্নীত করার কোন গুরুত্ব দেয়নি ও চেষ্টা করেনি।

সোরাইয়া সাইয়েদ : ঐতিহ্যবাহী ক্যালিগ্রাফি করার ক্ষেত্রে উপাদান ও সরঞ্জামের গুরুত্ব কেমন?
হাসান চালাবি : হ্যা, ইসলামি ক্যালিগ্রাফিতে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঐতিহ্যবাহী নলখাগড়ার কলম ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ক্যালিগ্রাফির আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে না। এই কলমের নীব নমনীয় এবং সমমাত্রায় কালি আসে আর ব্যবহারে খুবই আরামদায়ক। লোহা বা ইস্পাতের নীব থেকে সেই দক্ষতা আসে না। এমনকি কালি তৈরি ও ব্যবহারে রয়েছে বিশিষ্ট্যতা। এটা ভুল শোধরানোর যোগ্য। ইউরোপীয় কালিতে তা পাওয়া যায় না। ইউরোপীয় কালিতে যে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় তাতে কালি শুকানোর পরে তরল করা যায় না। এতে হরফ অনেক ভারি আর পুরু হয়ে যায়। কিন্তু আমরা যে কালি ব্যবহার করি, সেটা বার বার পানি মিলিয়ে পাতলা এবং শুকিয়ে যাবার পরও তরল করা যায়, ভুল হলে কাগজ থেকে মুছে ফেলা যায়, ভুল ঠিক করা যায়।


সোরাইয়া সাইয়েদ : ইসলামি ক্যালিগ্রাফি কি কোন ধরণের ইবাদাত?
হাসান চালাবি : হ্যা, এটা একধরণের ইবাদাত। বাস্তবতা হচ্ছে, এটা মানুষকে ইবাদাতের মধ্যে অতিবাহিত  করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পাপ থেকে পালিয়ে আসা হলো ইবাদাত।’ একজন ব্যক্তি যে কুরআন ও হাদিসের বাণী দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করছে, সে যদি সেটা না করে অন্য কাজে সময় নষ্ট করত। তাহলে সেটা পাপ। সুতরাং ক্যালিগ্রাফি করা ইবাদাত।

সোরাইয়া সাইয়েদ : ইসলামি ক্যালিগ্রাফি কি কঠোরভাবে নিয়ম মেনে করতে হয়? সৃজনশীলতা ও ব্যক্তি নৈপুন্য প্রকাশের কি কোন সুযোগ এতে আছে?
হাসান চালাবি : হ্যা, কারণ এর সৌন্দর্য রক্ষায় এই কঠোর নিয়ম-রীতি মেনে চলতে হয়। ক্যালিগ্রাফির বিন্যাস ও সাজানোর ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার সুযোগ রয়েছে।


সোরাইয়া সাইয়েদ : সমকালীন শিল্পীদের কাজে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
হাসান চালাবি : সমকালীন শিল্পকলাকে একটি ক্ষণস্থায়ী প্রবণতা হিসেবে মনে করি। এর শিল্পীরা শিল্পকর্মে যে অভিনিবেশে ক্যালিগ্রাফিকে প্রয়োগ করেন, তার তুলনায় একজন ঐতিহ্যবাহী ক্যালিগ্রাফার তার কাজে অনেক অনেক বেশি অভিনিবেশ দিয়ে থাকেন।

সোরাইয়া সাইয়েদ : ইস্তাম্বুলকে কি আপনি বর্তমান সময়ে ইসলামি ক্যালিগ্রাফির কেন্দ্র বিবেচনা করছেন? কেন সেটা আপনার মনে হচ্ছে?
হাসান চালাবি : হ্যা, ইস্তাম্বুলই এসময়ে ইসলামি ক্যালিগ্রাফির কেন্দ্রস্থল। তুর্কি ক্যালিগ্রাফারা একে ভালবেসেছেন আর্ট ফর্ম হিসেবে এবং এর চর্চাকে তারা ইবাদাত মনে করেন। তারা কঠোর নিয়ম-রীতি মেনে একে আর্ট ফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং তা বজায় রাখতে কঠিন পরিশ্রম ব্যয় করছেন। অনেক দেশে ক্যালিগ্রাফিতে ভুল থাকা সত্ত্বেও তা মেনে নেয়া হয়, কিন্তু তুরস্কে কঠোর নিয়ম-রীতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ক্যালিগ্রাফি করা হয়।


সোরাইয়া সাইয়েদ : বর্তমানে ক্যালিগ্রাফির অবস্থান কি এবং তুরস্কে এর চাহিদা কেমন?
হাসান চালাবি : হ্যা, অন্য দেশের তুলনায় তুরস্কে এর অবস্থান অতি উচ্চে এবং এর চাহিদা প্রচুর সংখ্যক এখানে, বিশেষকরে ইস্তাম্বুলের মত এত মানসম্পন্ন ইসলামি ক্যালিগ্রাফি আর কোথাও হয় না। এখানে ইসলামি ক্যালিগ্রাফি অন্যসব শিল্পকলা থেকে বেশি হয়। সব ধরণের ভবন ও প্রাসাদে এই ক্যালিগ্রাফি সংরক্ষণ করা হয়।

সোরাইয়া সাইয়েদ : গত ৫০ বছরে ক্যালিগ্রাফি এবং এর উন্নয়নে কি ধরণের পরিবর্তন আপনি দেখছেন?
হাসান চালাবি : এই শিল্পকলায় আগের তুলনায় অনেক বেশি লোকজন সম্পৃক্ত হয়েছে। কিন্তু এর মানগত উন্নয়নে যে সময় ও পরিশ্রম দেয়া দরকার তা কোথায়। বিশেষকরে এই শিল্পটি দিনে ৩০ ঘন্টা অভিনিবেশ ও চর্চা দাবি করে, আর সেটা আসলেই সম্ভব নয়।


সোরাইয়া সাইয়েদ : ধারণা করা হয়, পুরুষের তুলনায় অধিক সংখ্যায় মহিলারা ক্যালিগ্রাফির পাঠ গ্রহন করে থাকেন। এব্যাপারে আপনার মত কি?
হাসান চালাবি : ইতিহাসে দেখা যায়, বেশি সংখ্যক সফল মহিলা ক্যালিগ্রাফার পাওয়া যায় না। আমার মত হচ্ছে, মেয়েরা অধ্যয়নে যতটুকু সময় ব্যয় করে থাকে সে তুলনায় তারা ততটা মেধাবি নয়। স্কুল ছেড়ে আসা তরুনী মেয়েরা যখন এই শিল্পকলায় আসে, অল্প সময়ের ব্যবধানে তারা বিয়ে করে সংসারে ঢোকে আর বাচ্চা নিয়ে শিল্পচর্চায় ইতি ঘটে। ক্যালিগ্রাফার কামিল এফেন্দি ৯৩ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেছেন। ইন্তিকালের আগে বলেছিলেন, সেই বয়সে তিনি পুরোপুরি ক্যালিগ্রাফি শিক্ষা সমাপন করতে পারেননি। হামিদ বে ৯৫ বছর বয়সে দুনিয়া ছেড়ে যান। তিনি মারা যাবার কিছু আগে বলেন, ক্যালিগ্রাফি শেখা শেষ করতে তার ১০০ বছর লাগবে। সুতরাং ৪/৫ বছর ক্যালিগ্রাফির শিক্ষা নিয়ে একজন মহিলা সংসারে গিয়ে বাচ্চা লালন-পালন করে কিভাবে প্রত্যাশা করেন যে তিনি অগ্রগামী হবেন?

সোরাইয়া সাইয়েদ : ঐতিহ্যবাহী ইসলামি সমাজে একজন ক্যালিগ্রাফারের ভূমিকা কি? এই ভূমিকা কি কোন পরিবর্তন আনে?
হাসান চালাবি :  কোন পরিবর্তন আসে না। একজন ক্যালিগ্রাফারের ভূমিকা হচ্ছে একজন গবেষকের মত। তিনি সমাজের সেবা দিয়ে যেতে পারেন এবং জনগণের কাছ থেকে প্রেরণা আর উদ্দীপণা পেয়ে থাকেন।
সোরাইয়া সাইয়েদ : আপনার সবচেয়ে স্মরণীয় ক্যালিগ্রাফি কোনটি?
হাসান চালাবি :  ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে সন্তানের মত। আপনার যদি কয়েকটি সন্তান থাকে, তাহলে আপনি কাউকে অগ্রাধিকার দিতে পারবেন না, প্রত্যেকে তারা স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। আমি বলতে পারবো না, কে মন্দ আর কে ভাল। যদি আপনি আমাকে প্রশ্ন করেন, আমার কোন ইসলামি ক্যালিগ্রাফিটি সেরা? আমি বলব, এখনও শ্রেষ্ঠ ক্যালিগ্রাফিটি আমি করতে পারিনি। আমার কাজে এখনও আমি সন্তুষ্ট নই। প্রতি নিয়ত আমি খুজে ফিরছি আমার শ্রেষ্ঠ কাজের, আর চর্চা করে চলেছি, হয়ত কোন একদিন সেটা আমি করে ফেলব বলে আশা করি।


সোরাইয়া সাইয়েদ : ক্যালিগ্রাফির ভবিষ্যত নিয়ে আপনার ভয় আর প্রত্যাশা কি? কোথায় এর লক্ষ্যস্থল আপনি দেখছেন?
হাসান চালাবি :  ক্যালিগ্রাফি শিল্পকলা নিয়ে আমার কোন ভয় নেই। এর অগ্রযাত্রা সঠিক দিকে এগিয়ে চলেছে। এখন ক্যালিগ্রাফাদের মান ভাল অবস্থায় আছে। আর তাদের আর্থিক নিরাপত্তাও আছে। এটা অব্যাহত থাকলে ক্রমাগত ক্যালিগ্রাফারদের সংখ্যা যতটা না বাড়বে, তার থেকে বেশি দুর্নীতি আর বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়বে। তারা ক্যালিগ্রাফিতে অপকৌশল আর ছলচাতুরী প্রয়োগ করা শুরু করবে। তবে এটা বেশি দিন টিকবে না, তারপর সত্যিকার উন্নতি করা শুরু হবে। একসময় তুরস্কে ৭০ বছরের মত নিষিদ্ধ ছিল ইসলামি ক্যালিগ্রাফি। তা সত্ত্বেও এর শক্তি সঞ্চয় আর এগিয়ে চলা থেমে থাকেনি।

সোরাইয়া সাইয়েদ : আপনাকে মানুষ কি হিসেবে মনে রাখতে চাইবে বলে আপনি প্রত্যাশা করেন?
হাসান চালাবি :  তার জাতি ও ইসলামের একজন নগন্য সেবক হিসেবে।

--------------------------------------------
অনুবাদক- পিএইচডি গবেষক, প্রাচ্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


Saturday, September 19, 2015

Sattar Maszid : A calligraphic architecture ক্যালিগ্রাফির বিস্ময় সাত্তার মসজিদ


 In Bangladesh, Sattar Maszid is a great calligraphic architecture for future religious buildings. Masha Allah, My a big project is going to finished in next few month..Insha Allah, This is Sattar Maszid in Sreepur near Dhaka, Bangladesh, Main Calligraphy of Grand Ustad Mozaffar Ahmad, Turekey and another of me..it's all design, decoration, implemantation work by me, Please dua for me..

9 March. 2016

Some new pics added here.
south elevation of Sattar Maszid

Main entrance of  east side.




south elevation.
north side boundary fence. 

top panel calligraphy implementation work.
minaret
me and the maszid
                                     





রাজধানী ঢাকার অদূরে শ্রীপুরের মাওনায় আন্তর্জাতিক মানের বিশাল আয়তনের একটি মসজিদ নির্মান করা হচ্ছে। বিশিষ্ট্য ব্যবসায়ী আবদুস সাত্তার এ মসজিদটির নির্মাণ ব্যয়ভার বহন করছেন।



মসজিদটিতে পর্যায়ক্রমে আরবি ক্যালিগ্রাফি এবং ইসলামী নকশা দিয়ে সুশোভিত করা হবে। চমৎকার দৃষ্টিনন্দন শিল্প সুষমা মন্ডিত এ স্থাপনায় তিনশতেরও বেশি ন্থানে ক্যালিগ্রাফি ও অলঙ্করনের কাজ হবে। এজন্য তুরস্কের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার ও কুরআন-মুফাসসির মোজাফ্ফর আহমদ সম্ভাব্য ক্যালিগ্রাফি(সুলুস লিপি) এবং পার্শ্ব অলঙ্করণ কাগজে ও সফট কপি করে পাঠান। একাজে তার পক্ষ থেকে সহায়তা করেন ঢাকাস্থ তুর্কি স্কুলের শিক্ষক আবদুল কারিম। 



ক্যালিগ্রাফি ও সৌন্দর্য বর্ধন কাজে প্রয়োজনীয় ক্যালিগ্রাফি ও নকশা সম্পাদনা, তদারকি, সমন্বয় এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নতুন করে অঙ্কনের কাজ ও স্থাপনের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ক্যালিগ্রাফার মোহাম্মদ আবদুর রহীম। পবিত্র স্থাপনাটির মূল নকশা ও নির্মাণ করেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আর্কিটেক্ট কে এম মাহফুজুল হক জগলুল এবং তার প্রতিষ্ঠান ইন্টার্ডেক সিস্টেম। মূল স্থাপনার বাহিরে এ্যাকোয়া হোয়াইট মার্বেল পাথরে উৎকীর্ণ করে প্রায় দেড় হাজার বর্গফুট সুলুস লিপিতে আরবি ক্যালিগ্রাফি করা হবে।


 মসজিদের অভ্যন্তরে মার্বেল পাথর, জিপসাম টেরাকোটা, টাইলস গ্লেজ ফায়ার ও রঙের মাধ্যমে ক্যালিগ্রাফি ও অলঙ্করণ করা হবে। বাহির ও ভেতরে পবিত্র কুরআনের আয়াত দিয়ে সুলুস শৈলীতে এসব ক্যালিগ্রাফি করা হবে। এছাড়া মিহরাব, আর্চ, সিলিং, কলাম, বীম ও দেয়ালে ফুল-লতা-পাতার মটিফ নির্ভর ইসলামী নকশা ও আসমাউল হুসনার ক্যালিগ্রাফি সহকারে সুশোভিত করা হবে। এটি পাথর এনগ্রেভ, জিপসাম প্লাস্টার কাটাই, রঙ, টাইলস বার্ণ ও এ্যাম্বুস পদ্ধতিতে করা হবে।







বাংলাদেশে সাত্তার জামে মসজিদ প্রথম ব্যতিক্রমধর্মী একটি আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের অলঙ্করণশোভিত মসজিদ। বলা যায়, বাংলাদেশে মসজিদ স্থাপত্যে ক্যালিগ্রাফি ও অলঙ্করনে আন্তর্জাতিক শিল্পমানের সর্বোচ্চ প্রয়োগ এটিই প্রথম। বাংলাদেশে মসজিদ নির্মাণে আন্তর্জাতিক মানের ক্যালিগ্রাফি ও ইসলামী অলঙ্করণ শিল্পের অসাধারণ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাত্তার মসজিদ অগ্রদূত ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মসজিদের উত্তরপাশের দেয়ালে ক্যালিগ্রাফিতে ‘সাদাক্কাল্লাহুল আজিম’ সুলুস লিপিতে করা হয়।
গ্রীন মার্বেল কম্পানি থেকে ইনলে পদ্ধতিতে ক্যালিগ্রাফি করা হয়। ইঞ্জিনিয়ার মনিরুল ইসলাম কাটিং সিস্টেম চেক করছেন।
ওয়াটারজেট কাটার মেসিনে মার্বেল কাটা হচ্ছে।

কারিগর ডিজাইন অনুযায়ী ইনলে সেট করছেন।

চাপাই ওস্তাগর সাদেক ও তার দল প্লাস্টারে নকশা করেন ডিজাইন অনুযায়ী।

Mihrab in ground floor of Sattar Maszid, Pics taken-21/03/2016




Main gombuj(dome)

First floor

Round shape "Kalima Tayeba" for Miabari maszid, Nababgonj, Dhaka.




Sunday, September 13, 2015

বাংলার মুদ্রায় আরবি ক্যালিগ্রাফি Calligraphy on coin of Bengal


The Muslims arrived in Bengal with an adequate knowledge on coinage system. They introduced new features like name of Caliph or Khaliphath Kalima and mint for the first time on Bengal coins.-Coins from Bangladesh, Bulbul Ahmed and AKM Shahnawaz, 2013, p-85


বাংলায় মুসলিম শাসকরা প্রথম ধাতব মুদ্রা প্রচলনে টাকশাল স্থাপন করেন এবং মুদ্রায় আরবি ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার শৈল্পিক ছোয়া পায়।




মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের এই কীর্তি তাদের শিল্পের প্রতি ভালবাসা বহন করে। বেলা লাহিড়ী তার ‘অ্যা সারভে অব প্রি-মুহাম্মাদান কয়েনস অব বেঙ্গল’ প্রবন্ধে বলেন, পাল ও সেন আমলে বাংলায় কোন ধাতব মুদ্রার টাকশাল ছিল না এবং আর্থিক লেন-দেনে ধাতব মুদ্রার ব্যবহারের কোন নজীর পাওয়া যায় না, বরং সুলতানরা প্রথম এটা চালু করে এবং ধাতব মুদ্রা প্রচলনে টাকশাল স্থাপন করেন।

বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ মুদ্রায় আরবি লিপির ক্যালিগ্রাফি ব্যবহারে রুচিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। কুফি ও নাসখী লিপির সমন্বয় এসব মুদ্রায় আভিজাত্যের ছাপ এনে দিয়েছে। বিশেষ করে মুদ্রা প্রচলনে সুলতানদের জ্ঞান ছিল আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। দক্ষ কারিগরি কলাকৌশল আর শিল্পের প্রতি ভালবাসা লক্ষ করা যায় মুদ্রা ছাপ কর্মে। তুরস্ক, মিশর থেকে কারিগর এনে মুদ্রা তৈরিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল কিংবা উত্তর ভারতের মুসলিম শাসকদের টাকশাল থেকে কারিগর সংগ্রহ করা হয়েছে।
মুদ্রায় সঠিক মাপ ও ওজন বজায় রেখে ছাপ যন্ত্রের মাধ্যমে এটা তৈরি করা জনগণের মধ্যে ব্যপক সাড়া পড়ে। সুলতানগণ কোন যুদ্ধজয় কিংবা কোন শহরে অবকাশকালীন রাজধানী কিংবা বাণিজ্যিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে টাকশাল স্থাপন করতেন। জনগণ নিজেদের গচ্ছিত সোনা-রূপা দিয়েও দিনার-দিরহাম তৈরি করে নিতে পারতেন টাকশাল থেকে। এতে মুদ্রা ব্যবস্থা দ্রুত উন্নতি লাভ করে ও সরকারি কোষাগার সমৃদ্ধ হয়।

Saturday, September 12, 2015

A book 'Coins from Bangadesh' বাংলাদেশের মুদ্রা

 

I collect a book of coin of Bangladesh. It's a very useful for research work. It's contain of coin of ancient to modern time.


নিউ মার্কেট থেকে মুদ্রা বিষয়ক বইটি সংগ্রহ করলাম। আমার পিএইচডি গবেষণায় এটা বেশ কাজে লাগবে।

কয়েকদিন আগে ‘টাকা জাদুঘর’ পরিদর্শনে গিয়ে টাকায় নিজের ছবি তুললাম..। ঢাকার মিরপুরে স্টেডিয়ামের পাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেনিং ভবনে এই জাদুঘর। প্রাচীন মূদ্রা থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক দেশের স্মারক মুদ্রাসহ নোটের সমাহার রয়েছে।

Monday, August 3, 2015

Bangla Calligraphy : Feelings and Style বাংলা ক্যালিগ্রাফি : অনুভব ও শৈলী

 




-মোহাম্মদ আবদুর রহীম
মানুষ জীবনযাপনে বাহ্যিক প্রয়োজন পূরণের পরও মানসিক আনন্দলাভ বা আত্মপিয়াস মেটাতে কিছু দেখতে, শুনতে কিংবা ছুয়ে দেখতে চায়। তার সংস্কৃতির মধ্যে নিজকে প্রকাশ করতে কিংবা সৃজনশীল কিছু করে আনন্দ পেতে চায় এবং অন্যকে আনন্দ দিতে তার ইচ্ছে জাগে। সুতরাং বলা যায়, কোন জাতির সংস্কৃতির মধ্যে যে সৃজনশীল ও প্রতিভার পরিচয় আমরা দেখতে পাই, সেটাই শিল্পকলা।শিল্পকলার অতি প্রাচীন একটি শাখা হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি।ক্যালিগ্রাফি শব্দটা ইংরেজি এটা গ্রীক শব্দ ক্যালিগ্রাফিয়া থেকে এসেছে গ্রীক শব্দ ক্যালোস এবং গ্রাফেইনের মিলিত রূপ ক্যালিগ্রাফিয়া ক্যালোস=সুন্দর, আর গ্রাফেইন=লেখা
সুতরাং  ক্যালিগ্রাফির পরিচয় এভাবে দেয়া যেতে পারে-  হরফ বা টেকসট ব্যবহার করে চমৎকার লেখন শিল্পকে ক্যালিগ্রাফি বলে বর্তমানে, এই আর্ট ফর্মকে বিভিন্ন দেশ, ভাষা এবং ধর্মের লোকেরা আনন্দচিত্তে গ্রহণ এবং চর্চা করে চলেছেনপৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষার হরফে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। আরবি, ইংরেজি, চীনা, জাপানী প্রভৃতি ভাষার হরফের ক্যালিগ্রাফি মানুষকে মোহিত ও আনন্দিত করে।
ক্যালিগ্রাফির এখন দু’টো রূপ প্রচলিত। এক. ট্রেডিশনাল বা ঐতিহ্যবাহী ধারা এবং দুই. পেইন্টিং বা চিত্রকলা।
ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে সাধারণত হরফকে দৃষ্টিনন্দন করে লেখার বিষয়টি মূখ্য। এটা দু’ধরণের হতে পারে। এক. স্ক্রীপ্ট ক্যালিগ্রাফি এবং দুই. ভিজ্যুয়াল ইমেজ বা দৃশ্যমান ছবির মত ক্যালিগ্রাফি।
স্ক্রীপ্ট ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে, বইপত্র, নথি, ফরমান, মানপত্র ইত্যাদি কাগজের ওপর  হরফ দিয়ে যে ক্যালিগ্রাফি করা হয়, সেটাই স্ক্রিপ্ট ক্যালিগ্রাফি।আর ভিজ্যুয়াল ইমেজ ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে, শুধু হরফ বা বাক্য বা বাণী দিয়ে বিশেষ কম্পোজিশন বা সাজানো অথবা বিন্যাসের মাধ্যমে একটি ছবির মত তৈরি করা, সেটা প্রচলিত কোন কিছুর সাদৃশ হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।সেখানে শুধুমাত্র কালি ও ক্যালিগ্রাফি কলম ব্যবহার করা হয়। কাগজ বা কাপড় বা ক্যানভাস লেখার উপযোগি করে তোলা হয়। যাকে বলে মারবেলিং। ক্রীপ্ট ক্যালিগ্রাফিতে প্রস্থে কম বিস্তারের এবং ইমেজ ক্যালিগ্রাফিতে চাহিদা অনুযায়ী ছোট-বড় মাপের ক্যালিগ্রাফি কলম ব্যবহার হয়।
ক্যালিগ্রাফি কলম দিয়ে লেখার সময় এর কৌণিক দিকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে লেখা ডান থেকে বাম যায়, যেমন আরবি, সেটার কলমের কৌণিক দিক ডান দিকে এবং হরফের মোটা চিকণও তেমনি হবে। অন্যদিকে যে লিপি বাম থেকে ডানে যায়, যেমন বাংলা, তার কৌণিক দিক বামে হবে এবং হরফের মোটা-চিকণও সেভাবে হবে।
বাংলা হরফের আধুনিকায়ন হলেও প্রাচীন পুথির লিপি যাচাই করে দেখা গেছে এর স্বভাব বরাবর বর্গাকার এবং সমান্তরাল। পুথি লেখায় মাথাকাটা কলম অপেক্ষা গোলায়িত মাথার কলম ব্যবহার হয়েছে এবং লিপিকরের দক্ষতা ও সৌন্দর্যবোধের ভিন্নতায় টানা লেখায়ও ক্যালিগ্রাফির বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।
লিপির প্রয়োজন কেন?
একটা চিরন্তন সত্য হচ্ছে, মানুষের জীবনটা আয়ুর পরিধিতে সীমাবদ্ধ কিন্তু তার কীর্তি সময়কে অতিক্রম করে অমরত্ব লাভে সক্ষম আর জন্যই সচেতন মানুষ মাত্রই স্বীয় অমর কীর্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকেন আমরা অতীত এবং বর্তমান সময়ের পরতে পরতে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই, রাজা রাজন্যসহ সমাজপতি সচেতন শিক্ষিত শ্রেণী তাদের কীর্তিকথা বিজয়গাথা, রাজ্যশাসনের নীতিমালা, উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রভৃতি লিপিবদ্ধ করে গেছেন
কালের অতল গহ্বরে অনেক কীর্তি হারিয়ে যায় আবার কোন উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় অতীত রহস্য
ভবিষ্যতের জন্য কীর্তির তথ্য জমা রাখার সহজ পন্থা হিসেবে লিপির অবলম্বন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া
এভাবে লিপির মাধ্যমে অতীত অভিজ্ঞতা চলে আসে বর্তমানের হাতে
হরফতত্ত্ব(Paleography)
প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার এবং সেসব লিপির আগাপাশতলা বের করার জন্য এক ধরণের জ্ঞান চর্চা করা হয়, এটা হরফতত্ত্ব নামে পরিচিত প্রত্নতত্ত্বে যে মটিফ(Motif) সংরক্ষণ করা হয়, তাতে টেরাকোটা 'তবক' বা চাকতি লিপি(terracotta tablet script), ধাতব ফলকলিপি(metal plates inscriptions), বা শিলা ফলকলিপি(stone inscriptions) প্রধান এছাড়া আরো নানান রকম উপাদান আছে, যা হরফতত্ত্বের অন্তর্ভূক্ত
এক বিচিত্র এবং অত্যন্ত কষ্টসাধ্য জ্ঞান চর্চা এমনও ঘটনা আছে একটি শিলালিপির পাঠোদ্ধার(decipher) করতে বছরের পর বছর গড়িয়ে যায় যদিও একটা পাঠ পাওয়া গেল, কিন্তু পরে তা ভুল প্রমাণিত হলো তবু প্রথম পাঠকে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়

লিপি নিয়ে যারা কাজ করেন
লিপি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কাজের ধরণ ভিন্ন ভিন্ন দেখা যায় কেউ লিপির প্রাচীন পাঠোদ্ধারে জীবন কাটিয়ে দেন কেউ নতুন লিপি তৈরির কাজ করেন, যাকে লিপিকার(Calligrapher/Calligraphist) বলা হয় আবার লিপি নিয়ে শিল্পকলা করেন যিনি, তাকে লিপিশিল্পী(Calligraphy Artist) বলে প্রত্নতত্ত্বের সাথে শিলালিপির পাঠোদ্ধার(decipher) বিষয়টি জড়িত ছাপাখানা, বই হাতে লেখা, প্রচ্ছদ, বই অলঙ্করণ প্রভৃতির সাথে নতুন লিপি বা প্রচলিত লিপির নতুন সংস্করণ করেন লিপিকার আর শিল্পকলায় লিপিকে অনুসঙ্গ করে কিংবা লিপি দিয়েই শিল্পকর্ম করেন লিপিশিল্পীরা আমাদের ঢাকার চারুকলায় প্রাচ্যকলা বিভাগে বিষয়ে তালিম দেয়া হয় তবে অধিকাংশ ভাষার লিপি দিয়ে এখন আর শিল্পকলার প্রবাহমান ধারা লক্ষ্য করা যায় না এক্ষেত্রে চীনা জাপান বা কোরীয় লিপি চিত্রের অনুসঙ্গ হিসেবে এখনও টিকে আছে আর আরবি লিপি নিজেই একটি জীবন্ত শিল্পকলা হিসেবে ঐতিহ্যবাহী ধারা এবং আধুনিক শিল্পকলা হিসেবে প্রবহমান
বাংলা ভাষা লিখতে বিভিন্ন লিপির ব্যবহার
অঞ্চলে মুসলিম ইংরেজ আমলে আরবি, ফারসি বা উর্দু হরফে বাংলা লেখা ছাড়াও সিলেটি, নাগরি, কায়েথি, উড়িয়া, নেওয়ারি, রোমান আসামি লিপিতে বাংলা গ্রন্থ রচনার নজির রয়েছে
মুসলিম আমলে মুসলিম এবং হিন্দু লেখক নির্বিশেষে আরবি-ফার্সি হরফে বাংলা পুথি লিখেছেন  ঢাবি পুথিশালায় রক্ষিত আরবি হরফে লেখা বাংলা ভাষার তেত্রিশটি পুথির কথা জানা যায় এর অধিকাংশের লিপিকালের হদিস নেই তবে গবেষকরা বলছেন, এগুলো ১৮ শতকের আগে লেখা এগুলি সৈয়দ সুলতানসহ অপরাপর মুসলিম লেখকদের রচিত বাঙলা ভাষার পুথি আরবি হরফে কেন লেখা হল? ইতিহাসে দেখা যায়, সুলতানি আমলে(১২০৪-১৫২৬ ইসায়ি) প্রাপ্ত প্রায় সব শিলালিপি বিশুদ্ধ আরবি ভাষা উৎকৃষ্ট আরবি ক্যালিগ্রাফিতে করা হয়েছে সুতরাং সাধারনের কাছে আরবি ভাষা সহজপাঠ্য গ্রহনীয় ছিল এই তেত্রিশটি পুথির প্রায় সবকটি ধর্মীয় বিষয়ে লেখা জনগণের চাহিদা মোতাবেক এবং পাঠের সুবিধার্থে এগুলো আরবি হরফে লেখা হয়েছে বলে গবেষকদের ধারণা আর ৬০দশকের শেষ দিকে চট্টগ্রামে জুলফিকার আলি আরবি-ফার্সি(উর্দু) লিপিতে একটি বাংলা পত্রিকাও বের করতেন বলে জানা যায়
প্রাচীন কাল থেকে বলা যায়, ইসায়ীপূর্ব তিন হাজার বছর থেকে বাংলা লিপি যাত্রা শুরু করেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলা ভূখণ্ডের বাইরের ব্রাহ্মী লিপি থেকে বাংলা লিপির উৎপত্তি। তবে আধুনিক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলা ভূখণ্ডের ভেতর থেকেই এ লিপিনাগরী লিপিবাব্রাহ্মী লিপি (যা থেকে নাগরী লিপির জন্ম বলে দাবি করা হয়) থেকে জাত নয়; বরং তা স্বাধীনভাবে উদ্ভূত। আরও জানা যায়, ‘বাংলালিপি ব্রাহ্মণদের হাতে তৈরি নয়, দেশের- প্রাচীন আমলের সাংখ্য-যোগ-তন্ত্রবাদী বা তাদেরও পূর্বপুরুষদের- মহান কীর্তি। অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, আরবি, সংস্কৃত ইত্যাদি বর্ণমালার প্রত্যেকটি হচ্ছে, একেকটি দেবাক্ষর প্রত্যেকটি আরবি হরফের যেমন এক একজন অধিপতি ফেরেশতা আছে বলে কল্পনা করা হয়েছে; তেমনি প্রত্যেকটি সংস্কৃত বর্ণেরও আছে এক একজন অধিপতি দেবতা। একইভাবেবাংলা’-বর্ণেরও যে প্রতিটিরই এক একটি দেবতা বা দেবী আছে,  নতুন এ তথ্যটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাই বর্তমান সময় থেকে অতি নিম্নস্তরের ভারতীয় বাঙালি এবং বাংলাদেশি বাঙালিরা (মুসলিম-অমুসলিম-নির্বিশেষে) দাবি করতে পারবে, সংস্কৃত লিপির মতো বাংলা লিপিওদেবাক্ষরএবংধর্মাক্ষর বটে। আর তা ব্রাহ্মণদের নয়; তাদের- প্রায় তিন হাজার বছর আগেকার পূর্ব পুরুষের অবদান।



প্রাচীন বাংলা লিপির প্রতিটি বর্ণের একটি চমৎকার বর্ণনা আমরা খুজে পেয়েছি 'বর্ণোদ্ধার তন্ত্র' 'কামধেনু তন্ত্র' নামক দু'খানি প্রাচীন গ্রন্থে যদিও সেখানে বাংলা লিপি কথাটার সরাসরি উল্লেখ নেই কিন্তু বর্ণনা ভঙ্গি অক্ষরের আকৃতি রূপায়ণে তা বাংলা লিপি বলে চিহ্নিত করেছেন গবেষকগণ বই দুটিতে 'প্রাণ-তোষিণী' নামক তন্ত্রের ভিত্তিতে বিবৃত নামোল্লেখহীন লিপির 'স্বর' 'ব্যঞ্জন বর্ণে' ধর্মীয় মহিমা, আকারগত বিবরণ এবং 'বাংলা' অন্যান্য পার্শ্ববর্তী প্রাচীন লিপির সঙ্গে তুলনা কি রকম হতে পারে তা আমরা দেখতে পারি
. . কামধেনুতন্ত্রে (প্রথম পটলে)- ''
'হে বরাননে! -কারের অতি গোপনীয় তত্ত্ব শোন শরৎকালের চাঁদের মতো ( বর্ণ) সর্বদাই পঞ্চকোণময় পঞ্চদেবময় ( বর্ণ) শক্তি সমন্বিত স্বয়ং কৈবল্যমূর্তির অনুরূপ ( বর্ণ) সগুণ নির্গুণযুকাত দ্বিবিন্দুযুক্ত ( বর্ণ) নিজেই প্রকৃতি রূপিনী'

অর্থ- ওহে সুন্দর মুখবিশিষ্ট্যা(দূর্গা, উমা দেবী)! বাংলা - অক্ষরের গোপন দর্শন/কথা শোন বাংলা ঋতুর তৃতীয় ঋতু শরৎকালে যে পূর্ণ চাঁদ ওঠে, সেটার মত "" অক্ষরটি সব সময় পাঁচকোনা বিশিষ্ট পাঁচ দেবতা(দূর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিক, গণেশ) শক্তি এর মধ্যে নিহিত এটা নিজেই শিব মুর্তির মত, এতে গুণ যেমন আছে, আবার তা নেইও এই অক্ষরে দুটো বিন্দু বা পুটলি আছে, এজন্য এটা প্রকৃতি(দেবী) রূপ সাদৃশ্য

. বর্ণোদ্ধারতন্ত্র- ''
'ডান দিকে কোঁকড়ানো () বাঁকানো এবং বাম দিকে প্রসারিত; তার উপরে যুক্ত রেখা ডাইনে, উপরে শংকর (অবস্থিত) বিধি নারায়ণ তথায় ক্রমানুসারে স্থিত অর্ধমাত্রা, শক্তির ধানস্থ রূপ বলে কথিত ।।।।


অর্থ- এই '' অক্ষরের ডানদিকে কোঁকড়ানো(গোলায়িত) আর বাঁকানো এবং বাম অংশ প্রসারিত অক্ষরটির উপরে একটি মাত্রা আছে যা অক্ষরের সাথে মিলানো ডাইনে, উপরের দিকে পেঁচানো চন্দ্রবিন্দুর মত শিব চিহ্ন আছে(প্রাচীনকালে এরকম ছিল, এখন নেই) শিবের নিয়ম অনুযায়ী তা যথাস্থানে রাখা হয়েছে তবে এর উপরের মাত্রাটি অর্ধেক হবে, যেটা শক্তি অর্থাৎ শিবের ধ্যানমগ্ন রূপ বলে প্রকাশ করা হয়েছে
বাংলা অক্ষর নিয়ে বাঙালদের ঐতিহ্যচিন্তা ভাষার প্রথম পথচলা থেকে শুরু হয়েছে শুধু প্রয়োজন বলে কথা নয় হৃদয়ের আকুতি এর সাথে মিশে আছে প্রাচীন পুথিপত্রে লেখাকে সুন্দর আর অলঙ্কার মণ্ডিত করার প্রয়াস বাঙাল ভূখণ্ডে প্রবলভাবে ফুটে ওঠে মধ্যযুগে
ছাপার হরফে বই আসার পরেও প্রচ্ছদ আর ভেতরের ইলাস্ট্রেশনে বাংলা হরফের শিল্পিত ব্যবহার চালু রয়েছে কিন্তু হরফ দিয়ে শিল্পকলা করার আবেগ আর স্পৃহা একেবারে হাল আমলের আমাদের চারুকলায় বাঙলা হরফ দিয়ে লিপিকলা বা ক্যালিগ্রাফি করার কোন ট্রেডিশন দেখা যায় না বিচ্ছিন্ন দু'একটা কাজ যা আছে তাতে এর প্রতি গভীর অভিনিবেশ প্রায় শুণ্যের কোঠায়
বাংলা ক্যালিগ্রাফির বর্তমান যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দুটো প্রধান চরিত্র রয়েছে এক. বইপত্রে প্রচ্ছদ এবং ইলাস্ট্রেশন দুই. লিপিকলা
বইয়ের প্রচ্ছদে শিরোনাম ক্যালিগ্রাফি স্টাইলে লেখার ক্ষেত্রে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হচ্ছেন অগ্রনায়ক তার তুলির টানে হরফের শিল্পিত অবয়ব একটি ধারার সৃষ্টি করেছে ধারায় যারা কাজ করেছেন তারা প্রায় সবাই চারুকলার
প্রায় একই রকম হরফের বলিষ্ঠভাব নিয়ে শিল্পী হাশেম খানের তুলির টানে অন্য একটি ধারা দেখা যায় তবে হাশেম খানের হরফে একটা গ্রামীণ সরল ভাবের সাথে শিশুর সরলতার অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অন্যদের মাঝে দেখা যায় না
আর বাংলাবাজারে ধর্মীয় বইপত্র এবং সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখা বইয়ে আরবি হরফের আদলে বাংলাহরফে ক্যালিগ্রাফিরও দেখা মেলে
হাতে লেখা সাইনবোর্ড দেয়াল লিখন :
এখন আর হাতে লেখা সাইনবোর্ড প্রায় দেখা যায় না দুই দশক আগেও চমৎকার আর্টিস্টিক বাংলা হরফে সাইনবোর্ড লেখা হত হরফে আলোছায়া আর উচুনিচু ভাবের সাথে শিল্পিত ছোয়া ছিল অসাধারণ তেমনিভাবে দেয়াল লিখন আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে বামপন্থীদের দেয়াল লিখনে যে শিল্পিত রূপ ছিল তা অন্যদের বিমোহিত করতএছাড়া ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র শিবিরের দেয়াল লিখনে হরফের প্রয়োগ বৈশিষ্ট্য আলাদা হলেও তা দৃষ্টি নন্দন ছিল।
একুশে উদযাপন উপলক্ষে শহীদ মিনারের আশেপাশের দেয়াল লিখন এক সময় এত বিচিত্র আর মান সম্পন্ন ছিল যে সৌন্দর্যপিপাসুরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে তা নয়ন ভরে দেখত চারুকলার ছাত্ররা বরারবর এই লেখাকে তাদের প্রেস্টিজ ইস্যু মনে করত এখন আর সেই মান নেই
এক সময় দেয়াল পত্রিকা পাড়া মহল্লায়ও বের করা হত এখন শিক্ষাঙ্গন থেকেও তা প্রায় হারিয়ে গেছে এসব লেখালেখিতে হরফকে সুন্দর করার যে প্রয়াস ছিল তাতে শিক্ষিত মাত্রই সুন্দর হাতের লেখার একটা গুরুত্ব ছিল আর এখন অধিকাংশ ছাত্রের হাতের লেখা দেখলে বাংলা হরফের প্রতি ভালবাসা দূরে থাক যেন হরফকেই তারা ভুলতে বসেছে
এই চিত্রের উল্টোদিকও আছে বাংলা হরফে ক্যালিগ্রাফি করার একটা প্রয়াস ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে পেইন্টিংয়ে হাশেমখান, কাইয়ুম চৌধুরী আর আবদুস সাত্তার বাংলা হরফকে অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করছেন চারুকলার সাম্প্রতিক কাজেও তা প্রভাব ফেলেছে
অন্যদিকে বলা যায় একাডেমিক শিল্পচর্চার বাইরে কিছু শিল্পী তাদের শিল্পকর্মকে বাংলা ক্যালিগ্রাফি হিসেবে তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন এদের কাজে অভিনিবেশ আর কঠোর সাধনা লক্ষ্য করা যায়
এসব বাঙলা ক্যালিগ্রাফিতে ধর্মীয় ভাব প্রাধান্য পেয়েছে টেক্সট ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাছাড়া দেশ মাতৃকা ভাষার প্রতি কমিটমেন্টও এসব কাজে দেখা যায় তবে ক্যালিগ্রাফিতে শিল্পমানে কোন ছাড় দিতে রাজি নয় এসব শিল্পী সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মণ্ডল, আরিফুর রহমান, আবদুর রহীমসহ প্রায় শতখানেক শিল্পী বাংলা ক্যালিগ্রাফির একটি নতুন ধারা দাড় করিয়ে ফেলেছেন
বাংলা টাইপোগ্রাফি :
ছাপার অক্ষর এক সময় সীসার ব্লক আর কাঠের ব্লকে হত গত৮০ দশকেও সেটা রমরমা ছিল লেটার হেড বা কোন শিরোনাম একটু ব্যাতিক্রম বা কোন ইমেজ ছাপাতে হলে জিংক ব্লকের দ্বারস্থ হতে হত এরপর টাইপরাইটারে এল মুনির কীবোর্ড তারপর মোস্তফা জব্বার কম্পিউটারের জন্য মেয়ের নামে সুতন্বি- তন্বি ফন্ট আনেন এখানে তিনি অনুঘটকের কাজ করেছেন, কারিগরি বা ফন্ট তৈরিতে তার হাত ছিল না হামিদুল ইসলাম তখন দৈনিক সংগ্রামের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন, বর্তমানে নয়াদিগন্তে আছেন তিনি জব্বারের অফিসে গিয়ে দিনের পর দিন হাতে ফন্ট বানিয়েছেন তখন স্ক্যানার আসেনি সুতরাং মনিটরের স্ক্রিনে আন্দাজের ওপর পাথ করার কাজ করতে হত এতে ফন্ট যথার্থ হচ্ছিল না প্রিন্ট দিলে হাতে আকা ফন্টের সাথে মিলে না ফলে কাজ বন্ধ হয়ে যায় একদিন শিল্পী হামিদুল ইসলাম বাটার পেপার দেখে নতুন আইডিয়া পেলেন আবার কাজ শুরু হল তিনি বাটার পেপারে ফন্ট একে দেন এবং সেটা মনিটরে কসটেপ দিয়ে লাগিয়ে হরফ পাথ করা হল এবার প্রিন্টে মনমত টাইপ বের হল এই অতি পরিশ্রমের মূল্য ছিল মাত্র বিশ হাজার টাকা এরপর তো প্রযুক্তির কল্যাণে আরো কত ফন্ট বের হল আগেই বলা হয়েছে, বাংলা ফন্টের স্বভাব বর্গাকার বা চারকোনা স্বভাবের সব হরফ আনুভুমিক সমান মাপের নয় এসব বিষয় মাথায় রেখে কাজ করতে হয়েছে এই উপমহাদেশের প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে অধিকাংশেরই নিজের লিপি নেই যেমন- উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত উর্দু লেখা হয় আরবি হরফে আর হিন্দি-সংস্কৃত লেখা হয় নাগরিতে সিলেটে একসময় নাগরি লিপিতে সমৃদ্ধ সাহিত্য ছিল সেক্ষেত্রে বাংলা(বাঙলা, বাঙালা, বাঙ্গালা) ভাষার নিজস্ব লিপি থাকায়, এর মর্যাদা গৌরব অন্যদের থেকে বেশি বাংলা ফন্ট ক্রমান্বয়ে দৃষ্টি নন্দন করতে এর অবয়বে পরিবর্তন করা হয়েছে ১৭৭৮ ইসায়িতে হ্যালহেডের বাঙ্গালা ব্যকরণ ছাপার মাধ্যমে বাঙ্গালা হরফে ছাপার প্রযুক্তি হুগলি থেকে শুরু হয় ছাপার প্রযুক্তির আগে বঙ্গে বাংলাদেশে হাতে বই লেখা হত সে ক্ষেত্রে বঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশের লেখকদের ফন্ট শৈলি উৎকৃষ্ট মানের ছিল


বাংলা পুথির লিপির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য শৈলি নিয়ে বেশ মজার তথ্য পাওয়া যায় টানা হাতের লেখায় বিশেষ করে তাল পাতায় লেখা পুথিতে শব্দের পর শব্দে কোন ফাক রাখা হত না এক শব্দের শেষ হরফের মাত্রা পরের শব্দের সাথে মিলে যেত প্রায় একই রকম হত -কার -কারের মত হত -কারের উড়ানি এবং -কারের উড়ানি লম্বা এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দেখা যায় কোন কোন ক্ষেত্রে ১৪ শতকের কোন পুথির লেখার শৈলির মান ১৮শতকের থেকে উৎকৃষ্ট ছিল আসলে পুথি লেখক অর্থাৎ পুথির কপি লেখক শিল্প মনোভাবাপন্ন হলে তার লেখা হত উৎকৃষ্ট এখন চারুকলায় বিশেষ করে প্রাচ্যকলায় বাংলায় যে ক্যালিগ্রাফি চিত্রকর্ম করা হচ্ছে, সেগুলো রেখা প্রধান এবং ছবির অনুসঙ্গ ভাবের সাথে মিল রেখে করা হয় তা ছবি হল কি না, সেটাই মূল কথা ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফি চর্চা এখানে গণ্য নয় তাহলে দেখা যেত কঞ্চি বা বাশের কলম দিয়ে বাংলা হরফ লেখা ক্যালিগ্রাফি করা হচ্ছে আর সেটা একটা নির্দিষ্ট নিয়ম কানুনের ব্যাপারও বটে কারন আরবি হরফ ডান থেকে বামে লেখা হয়, সেজন্য এর কলমের মাথার স্ট্রোক ডান দিকে ৪৫ ডিগ্রি কোন বরাবর থাকে, অন্যদিকে বাংলা বাম দিক থেকে ডান দিকে লেখা হয় বলে এটার কলমের মাথার স্ট্রোক বাম দিকে ৪৫ ডিগ্রি কোন বরাবর থাকে
এবার প্রশ্ন হতে পারে, ক্যালিগ্রাফি আর হ্যাণ্ড রাইটিং বা হাতের লেখার ভেতর কি পার্থক্য আছে?

ক্যালিগ্রাফি, হ্যাণ্ড রাইটিং থেকে আলাদা এজন্য যে, ক্যালিগ্রাফি একই সাথে শিল্পতৃষ্ণা এবং আটপৌরে জীবনের প্রয়োজন মেটায়।

অন্যদিকে, হ্যাণ্ড রাইটিং হচ্ছে যোগাযোগ বা শুধু প্রয়োজনকে তুলে ধরে নন্দন বা সৌন্দর্য সেখানে গৌণ।


ক্যালিগ্রাফি চর্চাকরা হয় এর ভেতরের সৌন্দর্য এবং অন্তরনিহীত শিল্পকে তুলে ধরতে।

ক্যালিগ্রাফি এবং হ্যাণ্ড রাইটিংয়ের মধ্যে আরেকটা মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, উপায় উপকরণের ভিন্নতা। ক্যালিগ্রাফি করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি কলম ব্যবহার করা হয়। আর সাধারণ লেখায় যে কোন কলম হলেই চলে।


আরবি ক্যালিগ্রাফি কলমকে 'কলম খাশাব' এবং 'কলম বুস' বলে।

ক্যালিগ্রাফি করার জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম এবং পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। যেমন একটি লিপিতে অলঙ্কার ব্যবহার হয় আবার দেখা যায় আরেকটি লিপিতে তা নিষিদ্ধ এবং আকার-আকৃতি একেক লিপির একেক রকম। বাংলা ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতেও নিয়ম-নীতি রয়েছে এবং এতে মাথা তেরছা করে কাটা ক্যালিগ্রাফি কলম ব্যবহার হয়।

ক্যালিগ্রাফির লিপির মধ্যে এই বৈচিত্র এসেছে সংস্কৃতি, ধর্ম এবং শিল্পবোধের প্রাত্যাহিক চর্চার মাধ্যমে
বাংলা ক্যালিগ্রাফির ট্রেডিশনাল ধারা সাংখ্য-যোগ-তন্ত্রবাদী আমলে ধর্মীয় দেব-দেবী আশ্রিত থাকার কারণে তা গোপন তান্ত্রিক চর্চায় ব্যবহৃত হত। এটির হরফ সুন্দর করার প্রয়াস পাল আমলের পুথিতে পাওয়া যায়। কিন্তু বহিরাগত কনৌজাগত সেনরা বাঙলা ভুখন্ড দখল করে একে ভুতলিপি নাম দিয়ে বাংলা ভাষা ও লিপি ধবংস করে এবং সংস্কৃত ভাষা ও নাগরি লিপি প্রতিস্থাপন করে। ফলে বাংলা লিপি অন্ধকারে চলে যায়।১২শতকে বখতিয়ার খিলজি বাংলা ভুখন্ড অত্যাচারী সেনদের হাত থেকে বিনা রক্তপাতে উদ্ধার করলে বাংলা ভাষা ও লিপি হৃত গৌরব ফিরে পায়।বাংলার স্বাধীন সুলতান ও মোগল আমলে মুসলমান এবং হিন্দু পুথি লেখকদের প্রচেষ্টায় লিপির উন্নয়ন ও সংস্কার সাধিত হয়। পঞ্চাশটি বাংলা হরফকে উচ্চারণগত সুবিধার জন্য এবং আরবি হরফের সাথে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় করার উদ্দেশ্যে মাত্র আঠারটি বাংলা হরফ চালু করে এবং এই আঠারটি হরফ দিয়ে মুসলিম পুথি লেখকরা পুথি রচনা করেছেন। এই হরফগুলোর মধ্যে তিনটি স্বরবর্ণ, যেমন-আ, ই, উ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ পনেরটি, যথা-ক, খ, গ, ছ, জ, ত, দ, ন, ফ, ব, ম, র, ল, স, হ।
১৮ শতকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ হওয়ার আগে ও পরে বাংলা লিপিকে সংস্কৃত লিপির আদলে লেখার ও প্রতিস্থাপন করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে গৌড়-বঙ্গ তথা ঘটি ব্রাহ্মনেরা। এজন্যও বাংলা লিপির উৎকর্ষতা আসেনি। এর আরো একটি কারণ হলো “ক-অক্ষর গোমাংস” থিউরী। আর্য ব্রাহ্মণেরা বাংলা লিপিকে গোমাংস অর্থাৎ গরুর গোস্তের সাথে তুলনা করে একে অচ্ছ্যুৎ ঘোষণা করে। মুসলিম আমলে সংস্কৃত ভাষা ও নাগরি লিপি বাদ দিয়ে বাংলার মুসলমানরা এর উন্নয়ন ও সংস্কার করার ফলে ব্রাহ্মণেরা এই হীন ষড়যন্ত্র করে। আর ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বাংলা হরফকে পেছনের দিকে নিয়ে যায় এবং এর ক্যালিগ্রাফিক বৈশিষ্ট্য ব্যাহত হয়।
পাকিস্তান আমলে বাংলা লিপির তেমন অগ্রগতি হয়নি, এমনকি শিল্পী-সাহিত্যিকরা যেমন এর প্রতি আদর-কদর নেননি, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি বরং বাংলা ভাষার প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণ করা হয়েছে। এতে বাংলা ক্যালিগ্রাফির উন্নয়নের কোন হদিস পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশে বাংলা ক্যালিগ্রাফি নিয়ে পেইন্টিংয়ের দেখা মেলে ’৮০ দশকে শিল্পী সাইফুল ইসলামের প্রদর্শনীতে। তারপর ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি ও ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র আয়োজিত দশক ব্যাপী প্রায় ডজনখানেক ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে অসংখ্য বাংলা ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম স্থান পায়। এছাড়া ‘বাংলা ক্যালিগ্রাফি’ শিরনামে ২০০০, ২০০৩ ও ২০০৫ সালে তিনটি প্রদর্শনী হয়েছে। এসব প্রদর্শনীতে বাংলা হরফকে ক্যালিগ্রাফিক মানে উন্নীত করতে আরবি কুফি, সুলুস, নাসখী শৈলীর আদলে যেমন প্রয়াস চালাতে দেখা যায়, তেমনি উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হরফকে বিকৃতি ও মাথাভারী করতে দেখা যায়। এছাড়া শুধুমাত্র ক্যালিগ্রাফি কলম দিয়ে কোন বাংলা ক্যালিগ্রাফির উপস্থাপন ছিল না। চারুকলা থেকে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা পেইন্টিংয়ের ভাব বজায় রাখতে গিয়ে ক্যালিগ্রাফির মৌলিক বিষয়কে গৌন করেছেন। তবে যারা বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি নিয়ে নিয়মিত কাজ করছেন তাদের কথা উপরে বলা হয়েছে।তারা যে একটি স্বতন্ত্র ধারা দাড় করিয়ে ফেলেছেন।তা সম্প্রতি তাদের কাজে প্রকাশিত হয়েছে।
শুধুমাত্র বাংলা ক্যালিগ্রাফি নিয়ে এখনও কোন বইয়ের খোজ মেলেনি। এবিষয়ে পত্র-পত্রিকায় যেসব লেখালেখি দেখা যায় তার কয়েকটির শিরনাম হচ্ছে-
এক. বাংলা ক্যালিগ্রাফি: সম্ভাব্যতা ও চলমান ধারা, মোহাম্মদ আবদুর রহীম, দৈনিক সংগ্রাম, ৯ মে, ১৯৯৭।
দুই. বাংলা বর্ণমালায় ক্যালিগ্রাফি, আরিফুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০০২।
তিন. বাংলা ক্যালিগ্রাফি ও ক্যালিগ্রাফি বিষয়ক ভাবনা, মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম, স্মারক ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি, ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র, জুলাই, ২০০২।
চার. নান্দনিক শিল্প ক্যালিগ্রাফি : বাংলাদেশে এর চর্চা প্রসঙ্গে, ড. মো. রফিকুল আলম, বাংলা ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী ক্যাটালগ, বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি একাডেমী, এপ্রিল, ২০০৩।
পাঁচ. বাংলা ক্যালিগ্রাফির শিল্পচিন্তা, আসাদ রহমান, ক্যালিগ্রাফি, বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি একাডেমীর ত্রৈমাসিক পত্রিকা, জুন, ২০০৬।
ছয়. মুবাশ্বিরের বাংলা ক্যালিগ্রাফি লোকজ নিবিড় আঁধারে, মানাম মায়মুন, ক্যালিগ্রাফি, বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি একাডেমীর ত্রৈমাসিক পত্রিকা, জুন, ২০০৬।

সাত. বাঙলা ক্যালিগ্রাফি : ভিন্ন এক শিল্প আলেখ্য, শেখের পো, শেখেরপো.ব্লগস্পট.কম, ৯ মার্চ, ২০১২।

আট. বাংলা ক্যালিগ্রাফিস্বগত কথন, আনোয়ার সেলিম, বাঙালিয়ানাম্যাগাজিন.কম, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪।
প্রসঙ্গ: খত থেকে দস্তখত
বাংলায় পেচানো বা স্ক্রীপ্ট আকারে নাম সই বা সিগনেচারকে বাংলা ক্যালিগ্রাফি বলে মত দিয়েছেন ইতিহাস গবেষক মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, এটা তার আবিস্কার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকগণ এটাকে তাদের একাডেমিক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করবেন বলে তিনি দাবি করেছেন। তিনি ‘নাম দস্তখত’কে সহি এবং ‘দস্তখত’কে শিল্পিত লিপিকলায়(Calligraphic System) অন্তর্ভুক্ত করেছেন। লিপিকলার বিকাশে দস্তখত একটি অনুকরনীয় মডেল এবং নান্দনিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন দস্তখতকে ফ্রিহ্যান্ড শিল্প বিবেচনায় এক একটা শিল্পকর্ম এবং এর নির্মাতারা স্থুল অর্থে এক একজন শিল্পী বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন। তিনি খত শব্দটি আরবি এবং একে শিল্প মন্ডিত লিপিকলা বলেছেন। আর দস্ত শব্দটি ফারসি এবং এর অর্থ হাত বলেছেন। দস্তখতের অর্থ করেছেন সহি বা স্বাক্ষর।
এখানে মজার বিষয় হল, আরবি এবং ফারসিতে স্বীকৃত ক্যালিগ্রাফারগণ একটি ক্যালিগ্রাফিক স্বাক্ষর ওস্তাদের কাছ থেকে পাশ করার পর বা ইযাজা লাভের পর ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মের নীচে দিয়ে থাকেন এবং সেখানে লেখা হয়, ‘কাতাবাহু আবদুল্লাহ/ওমর/নাম’। ‘কাতাবাহু’ শব্দটা শুধুমাত্র ইযাজা লাভের পরই দেয়া যায়, অন্যথায় শুধু নাম সই করা যায়। এই বিষয়টাকে আরবিতে ‘তাওকি’ বলে। হাজার বছর ধরে এই সিলসিলা বা নিয়ম চলে আসছে। এটা ফারসী ক্যালিগ্রাফির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ফার্সিতে ক্যালিগ্রাফিকে বলে ‘হুনারমান্দে খোশনবিশি’ বা ‘হুনারে খোশনবিশি’ আর কেতাবাত বা সাধারণ হস্তলিপিকে বলে ‘খতাতি’। আধুনিক ফার্সিতে সিগনেচারকে ‘আমেদা’ বা ‘নামে আমেদা’ বলে। দস্তখত শব্দটি আসলে প্রাচীন তুর্কি-আফগান-কুর্দি রুটের শব্দ। এর অর্থ ‘ক্যালিগ্রাফিক স্বাক্ষর’ নয়। তাহলে এসব অঞ্চলের ক্যালিগ্রাফির বই-পত্রে অবশ্যই থাকত এবং সেটা প্রচলিত হিসেবে এখনও পাওয়া যেত। কারণ ক্যালিগ্রাফিতে সিগনেচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন বাংলায় শুধু পেচিয়ে সিগনেচার দিলে সেটা ক্যালিগ্রাফি বলতে হবে, তা বিবেচ্য হতে পারে না। কারণ ঐ সিগনেচারের অধিকারীর স্বীকৃত বাংলা ক্যালিগ্রাফি শিল্পী বা ক্যালিগ্রাফার হিসেবে পরিচিতি থাকতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলাম কখনই ক্যালিগ্রাফার হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। আর আরবিতে খত অর্থ শুধু ক্যালিগ্রাফি নয়; লাইন, পথ, দাগ, রেখা, চিহ্ন ইত্যাদি অর্থও হয়।  যেমন- আকাশপথকে বলে খত আল জাউবি। বিমান সংস্থার নামকে যেমন-কাতার এয়ার লাইনস’কে বলে খুতুত আল জাউবিয়া আল কাতারিয়া।
আরহামের পিকটোগ্রাফি:
আরহামুল হক চৌধুরী বাঙলা হরফকে নানান রকম পেচিয়ে বাকিয়ে যেকোন বস্তু বা প্রাণীর চিত্র একেছেন তার কাজে প্রবাদ প্রবচন এসেছে চিত্রের অবয়ব তৈরিতে সাচ্ছন্দ্যরূপে ছবির আবেদনের সাথে অবয়ব এবং টেক্সট মিলে একাকার হয়ে গেছে এধরণের নিরীক্ষাধর্মী কাজে ঐতিহ্যকে ভিন্নভাবে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় যা কিছুটা নগর জীবনের বিলাসের ভেতর লোকশিল্প ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা পর্যন্ত তার বিভিন্ন মাধ্যমের ১১টি একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে হাতে আঁকা নক্সা করা আসবাব, ভেষজ রঙ নিয়ে কাজ, উচ্ছিষ্ট লোহার ভাস্কর্য থেকে দেশীয় গাছের বনসাইও রয়েছে।
শিল্পীর ক্যালিগ্রাফি কাজে পুরনো বাংলা বচন স্লোক এর ব্যবহার করা হয়েছে এবং লেখাটি সেই প্রক্রিয়ায় একটি আদলে পরিনত করা হয়েছে। কাজগুলো ইরানিতুগরাঘরানার রীতিতে প্রভাবিত কিন্তু মুল প্রতিপাদ্য আদি বাঙ্গালিয়ানায় গ্রথিত। দেশীয় প্রবচন এবং আদল বাংলা ক্যালিগ্রাফিগুলোতে একটি বিশেষ বাংলা চরিত্র দিয়েছে।
সচেতনভাবে বাহুল্য বর্জন করে শুধুমাত্র বচনকে প্রাধান্য দিয়ে কাজগুলো করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ৫২ কে মুখ্য করে ৫২টি নানান ধরণের কাগজে করা নতুন ক্যালিগ্রাফি কাজ সে করেছে।
বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে কুরআনের অনুবাদ:
২০১৪ সালের রমজান মাসে পবিত্র কুরআনের ত্রিশ নম্বর পারার অনুবাদ বাংলা ক্যালিগ্রাফি করেন মোহাম্মদ বেলাল। একাজে তিনি আর্ট কাগজের ওপর তেরছা মাথার ক্যালিগ্রাফি ফ্লাট মার্কার ব্যবহার করেন।
প্রবাসে বাংলা ক্যালিগ্রাফি:
বাংলাদেশের মেয়ে সিলভিয়া রেশমিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ড শহরে বাংলা ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী করেন।নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত সেখানে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। সেখানে তাঁর সব কটি ছবি দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। ক্রেতাদের মধ্যে তিনজন জাপানি তো রীতিমতো আপ্লুত হয়ে যান আবেগে। তাদের কাছে মনে হয়েছিলএই প্যাচানো বাংলা অক্ষরগুলো জাপানি অক্ষরের মতো, কিন্তু জাপানি নয়। এটা একটা ভিন্ন ভাষা কিন্তু ভিন্ন ভাষাকেও তাদের আপন মনে হয়েছিল।
বাংলা ক্যালিগ্রাফি ট্রেডিশনাল এবং পেইন্টিং, এই দুই ধারা একটি পর্যায় এসে দাড়িয়েছে।
সুতরাং বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে উন্নতি করতে চাইলে প্রাচীন পুথির লেখন বৈশিষ্ট্যকে আয়ত্ব যাচাই করতে হবে আরবি হরফের বৈশিষ্ট্য বাংলা হরফে প্রয়োগ করার চেষ্টা হবে আত্মঘাতি কাকের ময়ুরপুচ্ছ ধারণের মত নিঃষ্ফল প্রয়াসএর উন্নতি ও সংস্কারে শিল্পী, ক্যালিগ্রাফার ও সংশ্লিষ্টদেরকে সচেষ্ট হতে হবে। বাংলা ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ খোলা এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অতীব প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।
----------------------------
লেখক : ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগে পিএইচডি গবেষক।

Featured Post

Calligraphy Class started for Biggeners

I started new year Calligraphy Class. Today is 2nd class. Any person of no boundary on ages, can learn calligraphy, if he or she interes...