Wednesday, May 30, 2018

।।উসামা ও শায়খ অদাহ’র গল্প ।। ক্যালিগ্রাফির প্রাচীন দোয়াত ও কাগজের মাপ কেমন ছিল?




উসামা যখন ঘরে প্রবেশ করল, সে সময় তার উস্তাজ শায়খ অদাহ ক্যালিগ্রাফির নতুন একটি লাওহা বা শিল্পকর্ম তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন, তিনি মাথা না তুলে শুধু চোখ তুলে তাকালেন আর মুচকি হেসে বললেন, উসামা! বৎস আমার! স্বাগতম!


- প্রিয় উস্তাজ! আল্লাহপাক আপনার সকালকে সৌভাগ্যে ভরিয়ে দিন! মনে হচ্ছে, এই চমৎকার শিল্পকর্মটি “লাওহা তাতির” (সূক্ষ্ম পরিমাপের)?


- না, এটার পাশে ছাত্ররা আরবি ফুল-লতার নকশা আঁকবে, যাতে সেটা আরো নয়নাভিরাম হয়। বৎস! আজকে একটু আগে-ভাগেই এলে যে!


- উস্তাজি আপনার সান্নিধ্য আমাকে প্রতিদিনই এভাবে টেনে আনে। আজকে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর পেতে আমার মন উতলা হয়ে আছে!


- বৎস! বলো, কি জানতে চাও?


- গতকালের আলোচনা ক্যালিগ্রাফারের দোয়াত ও কাগজের পরিমাপের পর্যায়ে এসে শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার ধারণা ছিল, শুধু মিহবারাহ বা কালির পাত্রকে দোয়াত বলে, অথচ এর আরও ব্যাপক বিষয় আছে!


- আর কোন প্রশ্ন?


- উস্তাজি! প্রাচীন বাবেল বা ব্যাবিলনীয় কাগজের পরিমাপ ও সেটার ব্যবহার নিয়ে কিছুই জানি না, ফরাসি ও ইংরেজি কাগজের পরিমাপ আবিস্কারের আগে তা কেমন ছিল আর কিভাবে তা আমাদের কাছে এলো?


- শায়খ, মৃদু হেসে শিল্পকর্ম থেকে মাথা তুললেন এবং সেটা রোল করে তাকের ওপর রাখলেন, তারপর বললেন এটা অনেক লম্বা আলোচনা আর তোমার এই অনুসন্ধিৎসাকে আমি বাধা দিতে চাই না, আল্লাহ পাক চাইলে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাই!


- বলুন ওস্তাদজি, অধীর আগ্রহ নিয়ে আমি তা শুনতে চাই!


- ইলমি আভিধানিক অর্থে দোয়াত এমন একটি “আদাত” শব্দ, যাতে কালি সংরক্ষণ ও লেখার সরঞ্জামাদি একত্রে বুঝায়। আর পরিভাষায়- লিখতে যা যা লাগে সবকিছুকে একসাথে দোয়াত বলে। শব্দটির বহুবচন দুইয়াত/দুইয়ি/দুইয়্যু। দোয়াত নামবাচক শব্দটি দাওয়া থেকে উৎসারিত। কেননা কাতিব লেখার মেরামতি এ সরঞ্জামসমূহের মাধ্যমে করে থাকেন, যেমন দাওয়া বা ওষুধ দিয়ে দেহের চিকিৎসা করা হয়। সাহিত্যে বলা হয়, উপকারী হাতিয়ার হচ্ছে দোয়াত। এজন্য আরব মুসলমানেরা দোয়াতকে বিস্তারিত অর্থে কিংবা শুধুমাত্র কালির পাত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। যেখানে যে অর্থে ব্যবহার হয়, সেখানে সেভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন মসজিদে বা ইলিম চর্চার মজলিসে কতজন ছাত্র আসে তা বের করতে কালির পাত্রগুলো(মাহাবির) গুনে দেখার কথা বলা হয়েছে, ছাত্রত্বের পরিচয় হচ্ছে, প্রত্যেক ছাত্র স্বীয় কালির দোয়াত সাথে নিয়ে আসবে।


- মনে হয় শুধু একটি সরঞ্জাম ছাত্রের সাথে থাকতো না?


- হ্যা, দোয়াত শব্দ দ্বারা প্রায় সতেরটি সরঞ্জামের সমাহার বুঝায়।


- উস্তাদজি, সেগুলো কি একটু খোলাশা করে বলবেন?


- শোন বলছি, “আল-মাকলামাহ” হচ্ছে কলমদানির নাম। যাকে কলম রাখা হত। “মিহবারাহ” হচ্ছে কালির পাত্রের নাম। সেটা দু’ধরণের হতে পারে। এক. বড় কালির পাত্র, যাতে বেশি কালি সংরক্ষণ করা যায় আর অন্যটি ছোট আকারের কালির দোয়াত, যাতে কলম চুবিয়ে লেখার কাজ চালানো হয়। ওজনে হালকা হওয়ায় ছোট দোয়াতটি ক্যালিগ্রাফারের সাথে সবসময় থাকত। “আল-জাওনা” যা “আল-মালিক্ক” নামেও পরিচিত, ছোট অবয়বের কিন্তু বড় মুখের পাত্র, যাতে “লিকা” দিয়ে কালি রাখা হত। আর “লিকা” হচ্ছে রেশম সুতার দলা। যা দোয়াতে রাখলে কলমে সুষম কালি উঠে ও কলমের মাথা ভাল থাকে। কালি শুকিয়ে গেলে একটু পানি দিয়ে যে কাঠি দিয়ে লিকা নড়া-চড়া করে পুণরায় লেখার উপযোগী করা হয়, ঐ কাঠিকে “আল-মিলওয়াক্ক” বলে। কিতাবকে সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত বিশেষ ধরণের মাটির মিহি গুড়াকে “আল-মারমালাহ” বলে। কিতাবে কালি চুষে নেয়া ও কালির স্থায়িত্ব দিতে আঠালো বস্তু দিয়ে প্রলেপ দেয়াকে “আল-মানশায়াত” বলে। “আল-মেনফায” হচ্ছে কাগজকে মসৃণ করার হাতিয়ারের নাম। ছোট্ট পানির শিশি বা পাত্রকে “আল-সুকাত” বলে, লেখার দোয়াতের কালি শুকিয়ে গেলে সুকাত থেকে কয়েক ফোঁটা পানি দিয়ে কালির ঘনত্ব ঠিক রাখা হয়। কলমের মাথা যে পাতের ওপর রেখে ছুরি দিয়ে চেরা হয়, ঐ পাতটিকে “আল-মাক্তা” বলে। কাগজের মাথার দিক চেপে রাখা বা আঁকড়ে ধরার হাতিয়ারকে “আল-মিলজামাহ” এবং কলম রাখার জন্য ছোট আকৃতির রেশম বা উলের কাপড়খন্ডকে “আল-মুফরাশাহ” বলে। লেখার কাজ শেষ হলে কলম ‍ মোছা ও পরিস্কার করার কাপড়খন্ড বা টিস্যু জাতীয় কাগজকে “আল-মুমাস্সাহাহ” বলে। লেখার লাইন বা দাগ টানতে কাঠের রুলারকে “আল-মিস্তারাহ” বলে। আর কাগজে সোনার কালিকে চকচকে করতে মসৃণ পাথর লাগানো হাতিয়ারকে “আল-মিসক্কিলাহ” এবং ক্যালিগ্রাফি করার উপযোগি বিশেষ ধরণের কাগজকে “আল-মাহরাক্ক” বলে। এগুলো সবই দোয়াতের অংশ। এছাড়া ছুরি ধার বা শান দেয়ায় হাতিয়ার “আল-মাসান” এবং খাগের ক্যালিগ্রাফি কলম “আল-মিজবার”ও দোয়াতের অন্তর্ভূক্ত।


- উস্তাদজি, দোয়াত তৈরির উপকরণ কি কি?


- বিভিন্ন খনিজ ও ধাতব বস্তু দিয়ে, যেমন- সোনা, রূপা বা প্রাণীজ ও উদ্ভিজ উপকরণ দিয়ে দোয়াত তৈরি করা হয়, বিভিন্ন জাদুঘরে তার প্রাচীন নমুনা সংরক্ষণ করা আছে।


- অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই আপনাকে। প্রাচীণ কাগজের পরিমাপ কিভাবে করা হত?


- এ বিষয়ে কলকশান্দির উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে হে বৎস! বাগদাদের প্রাচীন কাগজের পূর্ণমাপ ছিল নয় ধরণের। দৈর্ঘে-প্রস্থের দ্বিগুণ, মিশরিয় কাপড় পরিমাপের একহাত পরিমান। আর লম্বায় দেড়হাত পরিমান। আর বাগদাদি নাকেচ বা খাটো মাপের কাগজ হচ্ছে দৈর্ঘ্য থেকে প্রস্থ চার আঙ্গুল কম হবে। দুই তৃতীয়াংশ মাপের মিসরি কাগজ পূর্ণ মানসুরি মাপের কাগজের এক তৃতীয়াংশ তুমার মাপের এবং প্রস্থ হবে হাতের এক তৃতীয়াংশ বরাবর। নিসফ মাপের কাগজ হচ্ছে মানসুরি তুমার মাপের অর্ধেক আর প্রস্থেও আধা হাত। সুলুস মাপের কাগজ মানসুরি এক তৃতীয়াংশ এবং প্রস্থেও হাতের এক তৃতীয়াংশ মাপের হওয়া। আর প্রসিদ্ধ মানসুরি মাপটি হচ্ছে প্রস্থে হাতের এক চতুর্থাংশ হওয়া। সগির মাপটিকে “আল-আদাহ” বলে, এটি প্রস্থে এক হাতের এক ষষ্ঠমাংশ পরিমাপের হবে। সিরিয়া বা শাম দেশের পূর্ণ মাপের কাগজ তুমার দৈর্ঘ্য হবে প্রস্থের দ্বিগুণ। সামি সগির মাপটি “ওয়ারাক তোইর” নামে বেশি পরিচিত। এতে তিন আঙ্গুল বরাবর প্রস্থ হবে আর এটা কবুতর ডাক বা পকেট সাইজ কিতাব লেখার কাজে ব্যবহৃত হত। সরকারি কাজে সিরিয়ায় প্রাচীনকালে চার মাপের কাগজ ব্যবহার করা হত। পুর্ণ মাপটি হচ্ছে, তুমার মাপের প্রস্থের দ্বিগুণ হবে দৈর্ঘ্য। আর নিসফ হামুবি হবে প্রস্থের দ্বিগুণ হবে দৈর্ঘ্য তুমার হামুবি। শামি আদাহ হচ্ছে তুমার মাপের দৈর্ঘ্যের এক ষষ্ঠমাংশ কম প্রস্থ । আর ওয়ারাক তোইর প্রস্থে তিন আংগুল বরাবর। (বাগদাদের বিশিষ্ট্য ক্যালিগ্রাফার ছায়ের শাকের তিরকিযির লেখার ভাবানুবাদ, ২০১৮ই.)


- মোহাম্মদ আবদুর রহীম, এমফিল, প্রাচ্যকলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments:

Featured Post

Calligraphy Class started for Biggeners

I started new year Calligraphy Class. Today is 2nd class. Any person of no boundary on ages, can learn calligraphy, if he or she interes...